নীলফামারিতে ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টি নেই, আমন-পাট নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

নীলফামারিতে ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টি নেই, আমন-পাট নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

নীলফামারিতে ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টি নেই, আমন-পাট নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

 

ইব্রাহিম সুজন, নীলফামারী:বাংলা দিনপঞ্জিকার হিসাবে এখন শ্রাবণ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। এ সময় প্রকৃতিতে থাকার কথা ভরা বর্ষাকাল। কিন্তু এ মৌসুমেও মিলছে না বৃষ্টির দেখা। আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকলেও একপশলা বৃষ্টির দেখা নেই। তাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন রংপুরঅঞ্চলের কৃষকরা।

আমনের চারা রোপণের উপযুক্ত সময় আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহ থেকে শ্রাবণের শেষ পর্যন্ত। এবার মৌসুমের শুরু থেকেই স্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা পাচ্ছেন না কৃষকরা। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না থাকায় সেচযন্ত্র ব্যবহার করে আমন চারা রোপণ করছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। ফলে আবাদে খরচ বৃদ্ধি ও উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন তারা। এদিকে গত কয়েক সপ্তাহের অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে গেছে খাল-বিল। পানির অভাবে কৃষকরা পঁচাতে পারছে না পাট। জমিতে পাট কেটে ফেলে রেখেছেন। অপেক্ষা করছেন বৃষ্টির পানিতে খাল-বিল ভরলে সেখানে পাট পঁচাবেন।

তবে কৃষি বিভাগ বলছে, চারা রোপণের এখনো সময় আছে অন্তত ১৫ দিন। এ জন্য তারা বিকল্প উপায়ে আমন চারা রোপণের পরামর্শ দিয়েছে কৃষকদের। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলছেন, রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পঁচানোর জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আমন চারা রোপণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকরা। কোথাও জমি তৈরি, কোথাও সেচ দেওয়া, কোথাও চারা রোপণ আবার কোথাও বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন করা হচ্ছে। বৃষ্টির আশায় না থেকে সেচযন্ত্র ব্যবহার করে আমন চাষাবাদে নেমে পড়েছেন কৃষকরা। খালে-বিলে তেমন পানি না থাকার পরও পাট কাটছেন অনেক চাষি। যেখানে সামান্য পানি পাচ্ছেন সেখানেই পঁচানোর জন্য মাথায় করে পাট নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে জায়গা ও পানির অভাবে রাস্তার ধারে ও জমির মাঝখানে পাট কেটে পালা করে রাখছেন।

নীলফামারী সদরের ইটাখোলা সিংদই এলাকার কৃষক আইনুল হক বলেন, প্রতিবছর বৃষ্টির পানি এই সময় ধান লাগানো শেষ করি। কিন্ত গতবছর থেকে বর্ষার ভরা মৌসুমেও বৃষ্টি দেখা পাচ্ছি না। এই সময় খাল-বিল ভরপুর থাকার কথা বৃষ্টির পানিতে। ধানের চারাও বড় হয়ে যাচ্ছে তাই বাধ্য হয়ে বৈদ্যতিক সেচ পাম্প দিয়ে জমি তৈরী করে চারা রোপণ করেছি। কিন্তু বিদ্যুতের যে লোডশেডিং এক জমিতে পানি দিতে গিয়ে ১০ বার বিদ্যু যায় আসে।

ডোমার উপজেলার চিলাইপাড়া এলাকার বাবু কৃষ্ণ চন্দ্র রায় বলেন, বর্ষাকালেও বৃষ্টি নাই। আর কত দিন অপেক্ষা করবো। বৃষ্টির পানি নাই। আবাদ করবো কেমন করি। মেশিনের পানি দিয়ে আবাদ করলে খরচ বেশি হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো গরিব মানুষ। চাষাবাদ না করলে খাব কী।

একই এলাকার কৃষক আলমগীর সরকার বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় এখনো আমনের চারা রোপণ করতে পারিনি। জমিগুলো রোদে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। শ্যালো মেশিন বা মোটর দিয়ে পানি তুলে জমি তৈরী করতে তো টাকা প্রয়োজন। টাকা পযসার সংকটে আছি বৃষ্টির পানি না হলে ধান লাগানো হবে না।

নীলফামারী সদরের রামগঞ্জ এলাকার কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, গত বছর পাট চাষ করে পঁচানো নিয়ে বিপাকে পড়েছিলাম।  এবারেও বৃষ্টি না হওয়ায় খাল-বিলে পানি নেই। পাট পঁচাতে পারছি না। পাট কেটে জমিতেই ফেলে রেখেছি। বৃষ্টির অপেক্ষায় আছি।

একই এলাকার কৃষক আব্দুস ছাত্তার বলেন, ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এমনিতে দিন দিন পাটের চাষ কমে যাচ্ছে। তারপরও পানির অভাব। সঠিকভাবে পাট পঁচাতে না পারলে উৎকৃষ্টমানের আঁশ পাওয়া যায় না। পাটের পাশাপাশি পাটকাঠির প্রয়োজন। তাই বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছি। যদি বৃষ্টি না হয় তবে রিবন রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. এস. এম. আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় আমন চারা রোপণে ব্যাঘাত ঘটছে। মূলত আমন চারা রোপণ হয় আকাশের বৃষ্টির পানির ওপরই। এখনো সময় রয়েছে বৃষ্টি হওয়ার। তবে বিকল্প উপায়ে আমন চারা রোপণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কৃষকদের।

তিনি বলেন, এখনও অনেক পাট কাটার বাকি রয়েছে। আশা করছি এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হবে। বৃষ্টি হলে কৃষকদের সমস্যার সমাধান হবে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুর আঞ্চলিক কর্মকর্তা ড. আবু ফজল মোল্লা বলেন, খাল-বিলে পানি না থাকায় রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পঁচানোর জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

আবহাওয়া অফিস বলছে, জুলাই মাসে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় ৩৫০-৪০০ মিলিমিটার। অথচ গত ২৩ দিনে ১৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই সময়টাতে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩২-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। তবে গেল ২০ দিনে রংপুর বিভাগে ২৬ থেকে ৩৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

রংপুর বিভাগে ২০২০ সালে জুলাইয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮০৪ মিলিমিটার। তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৪ দশমিক শূন্য ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর ২০২১ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১৯৬ মিলিমিটার, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৪ এবং সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২২ সালে জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার ।
চলতি মাসে ১৬৫ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন ২৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা ২০ দিন ধরে স্বাভাবিকের থেকে তাপমাত্রা বেশি ছিল ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত জুনের তুলনায় জুলাইয়ে বৃষ্টি কম হয়েছে। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে টানা বৃষ্টি না হলেও আগামী দুদিনে কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

আপনার সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার দিন

Explore More Districts