নারী ভোটারদের টানতে জামায়াতের বিশেষ কৌশল

নারী ভোটারদের টানতে জামায়াতের বিশেষ কৌশল

৩০ October ২০২৫ Thursday ১২:৪৫:৩৯ PM

Print this E-mail this


আমাদের বরিশাল ডেস্ক:

নারী ভোটারদের টানতে জামায়াতের বিশেষ কৌশল

জামায়াতের নারী বিভাগের কর্মী ও নেত্রীরাও চালাচ্ছেন ভোটের প্রচারণা। ইসলামি সভার নাম করে বাড়িতে হয় নারীদের জমায়েত। সেই জমায়েতে ধর্মীয় আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে চলে ভোটের প্রচার। প্রচারণার এই কৌশলে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, নারী ভোটাররাই প্রধান টার্গেট জামায়াতে ইসলামীর। এই টার্গেটে বহু আগে থেকেই চলছে কার্যক্রম। ফলে নারীদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে তাদের ভোট। বিপরীতে পিছিয়ে পড়ছে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো। নারী ভোটারদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী আর আওয়ামী লীগের ভোট বাগাতেও কাজ করছে জামায়াত। ‘ক্ষমতায় বিএনপি এলে এলাকায় থাকা মুশকিল হবে’ বলে বোঝানো হচ্ছে তাদের। একই সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে জানমাল রক্ষার প্রতিশ্রুতি। এসব কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জামায়াতের পক্ষে কাজ করছেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা। অন্যান্য এলাকায়ও জামায়াতে আস্থা রাখতে শুরু করেছেন নৌকার ভোটাররা।

পিরোজপুরের ২টি এবং পটুয়াখালীর ১টি আসনে রয়েছে জামায়াতের শক্ত প্রার্থী। বরিশালের বাকি ১৮টি আসনেও প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। বিএনপি যেখানে ভোটের মাঠে করছে মিছিল-সমাবেশ, সেখানে জামায়াতের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। ব্যানার-পোস্টার তো দূরে, দাঁড়িপাল্লার পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চাওয়াও চোখে পড়ে না। কী করে চলছে তাদের প্রচার, তা-ই খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিএনপি যখন রাজপথে মিছিল-সমাবেশে ব্যস্ত, ঠিক তখন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে পড়ছে জামায়াত। বিশেষ করে মহিলা ভোটারদের পক্ষে আনতে চলছে প্রাণপণ চেষ্টা। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন জামায়াতের মহিলা বিভাগের কর্মীরা। পুরুষ যখন বাইরে ব্যস্ত কাজে, ঠিক তখন ঘরের নারীদের কাছে গিয়ে ইসলামি সভার দাওয়াত দিচ্ছেন তারা। ৮/১০টি বাড়ির নারীদের নিয়ে হচ্ছে ওই সভা। উপস্থিত থাকছেন ৪০-৫০ জন করে নারী। অংশগ্রহণকারী কারও না কারও বাসাতেই হচ্ছে এই আয়োজন। সেখানে কুরআন-হাদিস নিয়ে চলছে আলোচনা। আয়াত আর সুরার বিশ্লেষণে বোঝানো হচ্ছে ইহকাল-পরকাল। বাছাই করা সুরার বাংলা অনুবাদে কৌশলে ঢোকানো হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা। পরকালে বেহেশত পেতে হলে ইহকালে থাকতে হবে ইসলামের সঙ্গে, বলছেন তারা। আর ইহকালের জীবনে যেহেতু রাজনীতি আর নির্বাচনও অন্তর্ভুক্ত, তাই কোথায় ভোট দিতে হবে, তা বলা হচ্ছে আকারে-ইঙ্গিতে।

বরিশাল নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার বাসিন্দা এক গৃহকর্তা বলেন, ‘আমাদের এলাকায় তো বহু বছর ধরে চলছে মহিলাদের এমন সভার আয়োজন। স্থানীয়ভাবে আমরা যাকে জানি তালিম নামে। এসব তালিমে থাকেন কেবল নারীরা। যেহেতু ধর্মীয় বিষয় আর কোনো পুরুষ থাকে না, তাই এ নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এখন তো শুনছি এটা নাকি জামায়াতের প্রচারণা।’

নগরীর কলেজ অ্যাভিনিউ এলাকার বাসিন্দা এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ একদিন আমার স্ত্রী বলে যে এবার ভোট দেবে জামায়াতে। রাজনীতি সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকা স্ত্রীর এমন কথা শুনে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি সে নিয়মিত অংশ নেয় মহিলা জামায়াতের তালিমে। সেখানেই ধর্মীয় আলোচনা শুনে তার বিশ্বাস জন্মেছে যে জামায়াতে ভোট দিলে সওয়াব পাওয়া যাবে।’

বরিশাল নগরীর আরও কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে মিলেছে তালিমের নামে জামায়াতের পক্ষে এভাবে নারীদের উদ্বুদ্ধ করার প্রমাণ। কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা মধ্যবয়সি এক এনজিও কর্মী বলেন, ‘এখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও এই তালিম তো চলছে বহু বছর ধরে। নগরীর প্রতিষ্ঠিত বহু মানুষের স্ত্রী-বোন জড়িত আছেন এর সঙ্গে। অন্তত ১২/১৩ বছর আগে থেকে কাউনিয়া এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে চলছে এরকম তালিম। মহিলারা একত্রিত হয়ে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করে মনে করে মাথা ঘামানো বা বাধা দেননি ঘরের কর্তারা।’

পটুয়াখালী-২ নির্বাচনি এলাকা বাউফল উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে আছেন দলের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ডা. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে প্রতিটি ওয়ার্ডকে ৩/৪ ভাগে ভাগ করে ৪/৫ জনের একেকটি টিম করে দেওয়া হয়। এ টিম প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়িতে করে তালিমের আয়োজন। আশপাশের ১০/১২টি বাড়ির নারীরা অংশ নেন তালিমে। মাসজুড়েই চলে তালিমের নামে এভাবে কৌশলী প্রচার। খোদ বিএনপি নেতাদের বাড়িতে পর্যন্ত চলে মহিলা জামায়াতের এই তালিম। পৌর বিএনপির এক নেতার বাড়িতে নিয়মিত এমন তালিম আয়োজনের খবর মিলেছে। ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িও বাদ পড়ে না তালিমের তালিকা থেকে।

নাম-পরিচয় না প্রকাশের অনুরোধ করে পৌর বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘মাত্র কদিন আগে বিষয়টি জানতে পেরে আমার বাড়িতে তালিম বন্ধ করেছি। এরা (জামায়াত) যে তৃণমূলের কতটা গভীরে গেছে, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না।’ বরিশাল নগরীতেও বিএনপির অনেক কর্মী-সমর্থকের বাড়িতে চলে মহিলা জামায়াতের তালিম। স্থানীয় বিএনপির এক নেতার পরিবারের সদস্যরাও জড়িত এই তালিম আয়োজনে। নগরে এমন অন্তত ১৭টি বাড়ির সন্ধান মিলেছে, যেগুলোর কর্তা বিএনপির কর্মী-সমর্থক অথচ তাদের বাড়িতে চলে জামায়াতের তালিম।

তালিমের নামে ঘরে ঘরে নারী ভোটার বাড়ানোর পাশাপাশি আরও নানা কৌশলে চলছে জামায়াতের প্রচার। পিরোজপুর-১ (সদর-জিয়ানগর-নাজিরপুর) আসনে জামায়াতের প্রার্থী মরহুম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুম সাঈদী। এখানেও নিত্যনতুন কৌশলে প্রচারণা চালাচ্ছে দলটি। জিয়ানগরে জামায়াতের রোকনের সংখ্যা ৯৩। কর্মী-সদস্য মিলিয়ে আছেন আরও ৩০ হাজার। এসব কর্মী-সদস্য-রোকনের ওপর রয়েছে কঠিন নির্দেশনা। প্রতিদিন মাথাপিছু কমপক্ষে ১ জন ভোটারের ভোট নিশ্চিত করতে হবে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে। সপ্তাহান্তে দিতে হবে নিশ্চিত ভোটারের তালিকা। শুক্র ও শনিবার দলের ৪০/৫০ জন কর্মী ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রচার চালান বাড়ি বাড়ি। ওয়ার্ডভিত্তিক অন্তত ৪টি মসজিদে আসরের নামাজে দাওয়াত দিয়ে আনা হয় লোকজন। এশা পর্যন্ত চলে ইসলামিক আলোচনা। এর ফাঁকে কৌশলে চালানো হয় ভোটের প্রচার।

সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে পিরোজপুর-২ নির্বাচনি এলাকার স্বরূপকাঠি উপজেলায়। এখানে জামায়াতের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন গুয়ারেখা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল লতিফ, ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এসাহাক শেখ, ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য কাউয়ুম শেখ ও আওয়ামী সমর্থক মৌলবি জসিমউদ্দিন। সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের অনেকেও এখন জামায়াতের ছায়াতলে। আব্দুল লতিফ শেখ বলেন, ‘আমি ওমরাহ করে এসেছি। শেষ জীবনে ইসলামি লাইনে থাকতে চাই। তাই জামায়াতের পক্ষে কাজ করছি।’ পরিচয় না প্রকাশের শর্তে জামায়াতের পক্ষে কাজ করা বেশ কয়েকজন আ.লীগ কর্মী বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আমাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে বিএনপি। দখল, চাঁদাবাজি-এমন কিছু নেই যা তারা করেনি। এখন আবার শুনছি স্বরূপকাঠি থেকে নাকি প্রার্থী দেবে তারা। স্থানীয় কেউ এমপি হলে তো বিএনপির অত্যাচারে এলাকা ছাড়তে হবে। তাই জামায়াতের পক্ষে কাজ করছি।’ এসবের পাশাপাশি ৭/৮ মাস আগে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করেছে জামায়াত। প্রতি কমিটিতে ৯ জন নারীসহ রয়েছেন ১৫০ সদস্য। কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণসহ যে কোনো পরিস্থিতি সামলাতে তাদের দেওয়া হয় নিয়মিত প্রশিক্ষণ। প্রচার-তালিম-ভোটকেন্দ্র সামলানোসহ সব কাজের জন্য করা হয়েছে পৃথক কমিটি। এক কমিটির সদস্য রাখা হচ্ছে না অন্য কমিটিতে। উপজেলা পৌর ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির ক্ষেত্রেও মানা হচ্ছে এই পদ্ধতি। ওয়ার্ড কমিটির অধীনে আবার আছে ইউনিট কমিটি। সবমিলিয়ে ভোটের মাঠের প্রচারণায় প্রচলিত সব পদ্ধতির বাইরে গিয়ে ভিন্ন কৌশলে হাঁটছে জামায়াত।

দরিদ্র অসহায় মানুষকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও অবলম্বন করা হচ্ছে গোপনীয়তা। দরিদ্র অনেক পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত মাসিক সহায়তা। জুলাই যুদ্ধে আহত আর শহীদপরিবারগুলো আছে এ তালিকায়। এসব সহযোগিতার বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের পর্যন্ত জানানো হয় না।

জামায়াতে ইসলামীর বরিশাল মহানগর আমির জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলেন, ‘১৭ বছর আগে থেকে আমাদের মহিলা বিভাগের এই তালিম চলছে। সেখানে ইসলাম আর কুরআন-হাদিস নিয়ে আলোচনা করেন নারীরা।’ এসব তালিমে ভোটের প্রচার হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কিংবা ভোট কি ইসলামের বাইরে? জীবনবিধানের সবকিছুই তো ইসলামের অন্তর্গত। আমরা যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল, তাই আমাদের তালিমে ইসলামের পাশাপাশি ভোটের প্রচার চলবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে মসজিদ ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রচারণার যে অভিযোগ, তা সঠিক না। আমরা মসজিদকে ব্যবহার করে কখনোই রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করি না।’

সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক


শেয়ার করতে ক্লিক করুন:

Explore More Districts