নাব্যতা সংকটে ৩ নদ-নদী/ বাণিজ্যে মন্দা মধ্যনগর

নাব্যতা সংকটে ৩ নদ-নদী/ বাণিজ্যে মন্দা মধ্যনগর

মধ্যনগর প্রতিনিধি
সারাবছর নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় মধ্যনগর বাজার একসময় হাওরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি ছিল। উপজেলার সুমেশ্বরী ও উব্দাখালী নদী এবং গোমাই নদের মিলনস্থলে শতাধিক বছরেরও বেশি সময় আগে মধ্যনগর বাজারের সৃষ্টি। প্রায় আধা কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও প্রায় দুইশো মিটার প্রস্থের মধ্যনগর বাজারের পূর্ব ও উত্তরে প্রবাহিত হচ্ছে সুমেশ্বরী নদী, দক্ষিণে গোমাই নদ, পশ্চিমে বইছে উব্দাখালী নদী। মধ্যনগর বাজারকে কেন্দ্র করে তিনটি নদ-নদী প্রবাহের কারণে দেশের যে কোনো অঞ্চলের সাথে সারাবছর নৌপথের যোগাযোগ একসময় খুবই সহজতম ছিল।
মধ্যনগর বাজারের ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, একসময় সোমেশ্বরী নদীর বুকে সারাবছর স্টীমার, জাহাজ চলাচল করতো। কিন্তু এখন সেইদিন আর নেই। শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে এখন আর আগের মত পানি থাকে না। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সাথে বালি আর পলি পড়ে সুমেশ্বরী নদীর বুকের অনেক স্থানে জেগে ওঠেছে চর। একইভাবে চর পড়েছে উব্দাখালী নদী ও গোমাই নদের বুকে।
স্থানীয়দের মতে, খনন না করায় নদ-নদীগুলো নাব্যতা সংকটে পড়েছে। এতে করে নৌপথে পণ্যবাহী কার্গো ও বড় ট্রলারের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বর্ষাকালে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মধ্যনগর বাজারে আসা পণ্যবাহী কার্গো ও ট্রলার বাজারের ঘাটে ভিড়তে পারলেও হেমন্তের ছয় মাস ছোট ছোট নৌকা চলাচল করা কঠিন। শুষ্ক মৌসুমে ব্যবসায়ীরা নিরুপায় হয়ে অধিক অর্থ ব্যয়ে সড়ক পথে পণ্য আমদানি করেন। যার প্রভাব পড়ে ক্রেতাদের উপর। স্থানীয় মানুষজনও দিনে দিনে পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার কলমাকান্দা বাজারসহ আশপাশের অন্যান্য বাজারমুখী হচ্ছে। সুমেশ্বরী ও উব্দাখালী নদী এবং গোমাই নদের নাব্যতা সংকটে মধ্যনগর বাজার হারাতে বসেছে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাণিজ্যিক জৌলুস।
মধ্যনগর বাজারে ৪৪টি আড়ৎ রয়েছে। ৩০/৩৫টি আড়তে প্রতিদিন ধান কেনাবেচা হচ্ছে। প্রতিটি আড়তে দৈনিক ৫০০ থেকে ৭০০ মণ ধান বেচাকেনা হচ্ছে। বাজার জমজমাট হলে প্রতিটি আড়তে দৈনিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ মণ ধান বেচাকেনা হয়। কিন্তু পুরোদমে কেনাবেচা শুরু না হওয়াতে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আড়ৎদাররা জানান, নৌপথে নাব্যতা সংকটের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যাপারীদের (বড় ব্যবসায়ী) বড় নৌকা ও ট্রলার বাজারের ঘাটে আসছে না। এতে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে, আর ধানের কেনাবেচাও জমছে না।
জানাযায়, মধ্যনগর এখনও দেশের অন্যতম বৃহৎ ধানের বাজার। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে ফড়িয়া ব্যাপারীরা। পরে সে ধান জমা করে বাজারের বিভিন্ন আড়তে। তবে কৃষক সরাসরি আড়তেও ধান বিক্রি করে থাকেন। এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে নভেম্বর পর্যন্ত চলে ধান কেনাবেচা। জেলার ধর্মপাশা, শাল্লা, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুরসহ নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও ঠাকরোকোনার ব্যবসায়ীরা মধ্যনগর বাজারের আড়তে ধান বিক্রি করেন। ব্যাপারীদের মাধ্যমে এসব ধান ভৈরব, আশুগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, বরিশাল, ঢাকার সাভার, সিলেটের কালীঘাটসহ দেশের নানা প্রান্তে রফতানি করে। আর এই ধান বেচাকেনায় নৌ-পথই তাদের একমাত্র পরিবহন মাধ্যম।
গলহা গ্রামের কৃষক মানিক মিয়া বলেন, ধান নিয়ে বাজারে এলাম। ১ হাজার ৩০টাকা মণ বিক্রি করেছি। ধানের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
মধ্যনগর বাজারের তরুণ ব্যবসায়ী কমরেড সরকার বলেন, প্রায় অর্ধশত বছর আগে থেকে গড়ে ওঠা এই ধানের আড়ৎগুলোতে এখনো বছরে ৩০/৩৫ লাখ মণ ধান কেনাবেচা হয়। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে খুচরা বাজারে কিছুটা কম দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। নদীতে পানি না থাকায় ব্যাপারীদের বড় ট্রলার ও কার্গো বাজারের ঘাটে আসছেনা। ফলে প্রতিযোগিতা মূলক বাজার জমছে না।

মধ্যনগর বাজারের ব্যবসায়ী আবুল বাশার বলেন, মধ্যনগর এখনও দেশের অন্যতম বৃহৎ ধানের বাজার হিসেবে টিকে আছে। বাজারে ৭০ থেকে ৮০টি ধানের আড়ৎ আছে। যা বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় ধানের অভ্যন্তরীণ রপ্তানি চালু রেখেছে। এছাড়া এই উপজেলা থেকে প্রচুর পরিমাণে মিঠা পানির মাছও রপ্তানি হয় ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
তিনি বলেন, সুমেশ্বরী ও উব্দাখালী নদীর নাব্যতা দ্রুত ফেরানোর ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে মধ্যনগর বাজার গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। নাব্যতা সংকট দূর করতে দুইটি নদীর বিভিন্ন স্থানে খনন কাজ করা খুবই জরুরি হয়ে দঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রিপন সরকার বলেন, মধ্যনগর বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে নৌ-পথে পণ্য আমদানী করে আসছে দীর্ঘকাল যাবৎ। এসব পণ্য আমদানি করা হয় বড় স্টীলবডি নৌকায়। সুমেশ্বরী নদীর নাব্যতা হারানোয় শুষ্ক মৌসুমের প্রায় ৬ মাস এসব পণ্যবাহী নৌকা আটকে থাকে পাশের ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের সানবাড়ীতে। পরে সেখান থেকে আমদানিকৃত পণ্য খালাস করে ছোট ছোট নৌকায় ঠেলা ধাক্কা করে মধ্যনগর পৌঁছায়। এটি খুবই ব্যয়বহুল, ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য। মধ্যনগরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সুমেশ্বরী নদীতে মধ্যনগর বাজার থেকে সানবাড়ী পর্যন্ত খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এদিকে উব্দাখালী নদীর গলহা থেকে মধ্যনগর পর্যন্ত খনন করে সারাবছর নৌচলাচল উপযোগী করার কথা বললেন- মধ্যনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ সরকার। তিনি আরও বলেন, গত বছর উব্দাখালী নদীর কিছু অংশে ড্রেজিং করা হলেও এখন তা বন্ধ রয়েছে। খনন কাজের মানও ভালো হয়নি।
ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মীর হাসান আল বান্না বলেন, এ বছর মধ্যনগর উপজেলায় ১৩ হাজার ২৪৬ হেক্টর জমিতে বোরো ফসলের আবাদ হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার ৪৮১ মেট্রিকটন। ইতিমধ্যে শতভাগ জমির ধান কাটা শেষ করা হয়েছে। ধানের সরকার নির্ধারিত মূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা।
মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ হাসান খান বলেন, উপজেলার উব্দাখালী ও সোমেশ্বরী নদী দুইটি খননের প্রয়োজনীতা আমি জেলা মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করেছি। আশা করছি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অচিরেই নদীগুলো খননের কাজ শুরু করবে।
সিলেট বাপাউবো (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী খুশী মোহন সরকার জানান, মধ্যনগরের সুমেশ্বরী নদী সহ সুনামগঞ্জ জেলার ২০টি নদী খননের জন্য বাপাউবো’র গৃহীত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। আশাকরি অচিরেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।

Explore More Districts