ধামাইল উৎসবে গানে গানে লোককবি প্রতাপরঞ্জনকে স্মরণ

ধামাইল উৎসবে গানে গানে লোককবি প্রতাপরঞ্জনকে স্মরণ

ধামাইল উৎসবে গানে গানে লোককবি প্রতাপরঞ্জনকে স্মরণ

হাওরভাটির নিভৃত পল্লীর লোককবি প্রতাপরঞ্জন তালুকদার। হাওরাঞ্চলে নারী সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে তিনি পরিচিত। নারীদের মধ্যে তার ধামাইল গান ব্যাপক জনপ্রিয়। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তিনি অবধারিত। গ্রামীণ নারীরা বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং রাখছেন এই ধামাইল রচয়িতাকে। ক্রমেই বাংলাভাষিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছেন তিনি।

এই জনপ্রিয় ধামাইল রচয়িতার স্মরণে জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার উপজেলার পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের প্রতাপ রঞ্জনের নিজ গ্রাম টাইলায় রোববার দিনব্যাপী ধামাইল উৎসব হয়। উৎসবে ৭ টি ধামাইলের দল অংশগ্রহণ করে।

‘ডুবিলে যমুনার জলে অন্তরে অন্তরে জ্বলে, মরণ ছাড়া অন্য উপায় নাই, ভাবিয়া কয় প্রতাপরঞ্জন সে আগুনে পুড়ে না বন, মরমে মরমে দহে প্রাণ’ রবিবার দিনব্যাপী উৎসবে বিভিন্ন উপজেলা থেকে সাতটি ধামাইল দল প্রতাপ রঞ্জনের এসব গান করেন। আয়োজকরা বলছেন, হাজারেরও উপরে গানের রচয়িতা প্রতাপ রঞ্জনের সৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে। তার এই সৃষ্টিকর্ম সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

স্থানীয়রা জানান, প্রতাপরঞ্জন ছিলেন একজন দিনমজুর। ক্ষেতে খামারে সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে গান লিখতেন। চারজন ছেলেমেয়ের অভাবের সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও তার লিখায় এর প্রভাব পড়তে দেন নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লিখে গেছেন ধামাইল গান। তবে এখনও তার অমর সৃষ্টিকর্ম চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। হতদরিদ্র এই শিল্পী হাজারের অধিক ধামাইল রচনা করেছেন। ২০০৯ সালে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তিনি। তার সব গান এখনো সংরক্ষিত হয় নি। পরিবারের মাথাগোঁজার ঠাঁইও রেখে যেতে পারেন নি তিনি।

ধামাইল সঙ্গীতশিল্পী গীতা রানী দাস বললেন, ধামাইল নাচে প্রতাপরঞ্জনের গান ছাড়া জমে না। আমরা সবচেয়ে বেশি প্রতাপবান্ধা গান করি। আমরা তাকে নারী সঙ্গীত রচয়িতা বলি। আমরা চাই তার গানগুলি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হোক।

প্রতাপরঞ্জনের বড় ছেলে প্রসেন তালুকদার বললেন, রাধারমণের পরেই আমার বাবার অবস্থান। তিনি হাওরে ধান কেটেছেন, অন্যের জমিতে কাজ করেছেন। রাতে যখন শুতেন তখন খাতা কলম নিয়ে গান লিখতেন। আমরা গভীর রাতে উঠে দেখতাম বাবা লিখছেন। আমরা বলতাম বাবা রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো। কিন্তু বাবা ঘুমাতেন না। শুকনো মৌসুমে কাজ নেই। তখন ইট কলে গেছেন কাজ করতে। গুনগুনিয়ে গান লিখেছেন। বর্ষা মৌসুমে নিজের বই নিয়ে বিভিন্ন জেলায় জেলায় গিয়ে বিক্রি করেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের দাবি ধামাইল উৎসব যেনো প্রতিবছরেই হয়। বাবার স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন হয়। কিছুদিন আগেও দেখেছি ইউটিউবে বাবার একটি
জনপ্রিয় গান রাধারমণের বলে প্রচার হচ্ছে। বাবার গানের সংরক্ষণ এবং মানুষের মধ্যে প্রচার নেই। এজন্য এরকমটি হচ্ছে। বাবার সৃষ্টি সংরক্ষণের সরকারি সহযোগিতা আশা করি আমরা। ধামাইল উৎসবের আয়োজক মো. লিটন মিয়া বললেন, ধামাইল উৎসব প্রতাপরঞ্জন করতেন। আমরা ছোট ছিলাম। এরপরে এই ধামাইল উৎসব হারিয়ে গেছে। হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ধামাইল উৎসবের আয়োজন করেছি। প্রতাপরঞ্জন তালুকদার
অনেক বড় একজন গীতিকার। নিজে দিনমজুরের কাজ করেও তার জীবনদশায় অসংখ্য গান রচনা করে গেছেন। তার নিজ বাড়িতে স্মৃতি রক্ষাতে স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করবে সরকার এই দাবি জানালেন তিনি।

প্রতাপরঞ্জন স্মৃতি পরিষদের সভাপতি জয়ন্ত সরকার বললেন, প্রতাপরঞ্জন তালুকদার এই অজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। দরিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেও সৃষ্টি রেখে গেছেন। রাতের বেলা কুপিবাতি জ্বালিয়ে অসংখ্য নারী সঙ্গীত রচনা করেছেন। ধামাইলে রাধারমণের পরেই প্রতাপরঞ্জনের অবস্থান। আমরা চাই প্রতাপরঞ্জনের সৃষ্টি ধরে রাখতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পৃষ্টপোষকতা ও সংরক্ষণ করবে।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবুল কালাম বলেন, প্রতাপরঞ্জন তালুকদার আমাদের গর্ব। দরিদ্র ও সাধারণ একজন মানুষ হয়েও সমাজ ও জাতির জন্য তার সৃষ্টি রেখে গেছেন। এই সৃষ্টি প্রচারের অভাবে মানুষ জানে না। তার কাজকর্ম প্রচার ও প্রসারে সরকার উদ্যোগ নেবে আশা করি। টাইলা গ্রামের সড়ক তাঁর নামে নামকরণেরও দাবি জানান তিনি।

ডি- এইচএ

Explore More Districts