ধনী-গরিব একাকার

ধনী-গরিব একাকার

বিশেষ প্রতিনিধি
স্বল্প আয়ের মানুষদের ওএমএস কার্ডের নিবন্ধন করার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন ধনীরাও। তাদের (ধনীদের) ধাক্কায় টিকতে পারছেন না গরিবরা। অর্থাৎ গরিবের চাল-আটায়, অপেক্ষাকৃত ধনীদের থাবা! সুনামগঞ্জ শহরের পুরাতন বাসস্টেশনের ওএমএস কেন্দ্রে রবিবার এমন দৃশ্য দেখা গেছে। খাদ্য বিভাগ অবশ্য বলেছে, কাল থেকে কেন্দ্রগুলোয় আরও বেশি শৃঙ্খলা বাড়াবে তারা।
রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সুনামগঞ্জ শহরের পুরাতন বাসস্টেশনে ওএমএস কেন্দ্রে তিন থেকে চারশ গরিব মানুষেরা ছিলেন অপেক্ষায়। তবে কেউই লাইনে ছিলেন না। এলোমেলোভাবে দাঁড়ানো ছিলেন। শতাধিক মহিলা ও পুরুষের ডিলারের ছোট্ট ওএমএস কেন্দ্রের দরজার সামনে যাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। চলছে ধাক্কাধাক্কিও।
এই প্রতিবেদককে পেছন দিক থেকে দেখে শহরের আরপিন নগরের মার্জিয়া বেগম (৩৫) নামের এক নারী এগিয়ে এসে জানালেন, বুধবার ও বৃহস্পতিবারে ভোরে এসেছেন। আজকে (রবিবার) এসেছেন শেষ রাত তিনটায়। তার স্বামী (খোকন মিয়া) রিক্সা চালান। এজন্য তাকেই তিনদিন ধরে ওএমএস কার্ডের জন্য নাম নিবন্ধন করতে আসতে হচ্ছে।
মার্জিয়া বললেন, ‘তিন পুয়া আর এক পুরি (৩ ছেলে ও ১ মেয়ে) আমরা জামাই-বউ (স্বামী স্ত্রী) দুইজন, এক বেটায় (একজন) রোজি (আয়) কইরা চালাইতা পারইন না। এর লাগি আইয়া (এসে) কষ্ট কররাম, পিছে আমরারে তইয়া, সামনেদি (লাইনের সামনে) একজন আইয়া (এসে) ১০ জনের ভোটার আইডি, ছবি দিয়া যারগি (চলে যাচ্ছে), আর আমরা রইদে পুইরা (রোদে পুড়ে), মেঘে ভিইজ্জা (ভিজে) পতিদিন (প্রতিদিন) যায়রাম-আয়রাম।’
সদরগড়ের মোছা. জাবেদা খাতুন জানালেন, তার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছেলেটি অসুস্থ্য, বয়স্ক অসুস্থ্য স্বামী কাজ করতে পারেন না। তিনদিন ধরে এসে লাইনে দাঁড়ান, প্রতিদিনই লাইনের সামনে দাঁড়ান। কিন্তু বেলা বাড়তে শুরু হলেই লাইনে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। ধাক্কাতে ধাক্কাতে পেছনে পড়ে যান তিনি। পরে এসে বলা হয় আড়াইশ নিবন্ধন করা শেষ। তাদেরকে চলে যেতে হবে।
কেবল এই দুই নারী নয়, রবিবার শেষ রাত থেকে লাইনে দাঁড়ানো সদরগড়ের সামিয়া বেগম, পারভিন বেগম, পুরান লক্ষণশ্রী’র মঞ্জু রানী দাস, নূর জাহান বেগম ও খাইমতরের আজিজুর রহমান দুর্বিসহ কষ্টের বর্ণনা দিলেন।
এই কেন্দ্রে তিনজন পুলিশ সদস্য শৃঙ্খলার জন্য দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু সকলেই দায়িত্ব পালন না করে ওই সময় ওএমএস কেন্দ্রের পাশের ঘরে বসা ছিলেন।
দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লা নামের একজন পুলিশ সদস্য এ প্রতিবেদককে বললেন, সকাল থেকেই ডিউটি করছি। প্রথমে খাদ্য বিভাগের দুই অফিসার একজন করে ডেকে ডেকে নাম নিবন্ধন করেছেন। শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা সহযোগিতা করেছি। দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় চা খাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ ভেতরে গিয়েছিলাম আমরা। ওই সময় লাইন ভেঙে যায় এবং একজন-আরেকজনকে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন।
ওএমএস ডিলার জাহাঙ্গীর বললেন, আমার এখানে কোন করণীয় নেই। আমি খাদ্য বিভাগের লোকজনকে সহায়তা করছি। আমি সিরিয়েলের বাইরে কোন ভোটার আইডির ফটোকপি হাতে নিচ্ছি না।
ওই কেন্দ্রে খাদ্য বিভাগের পক্ষে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তা অসীম কুমার তালুকদার বললেন, কেন্দ্রে শৃঙ্খলা বাড়াতে পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। আমরা ভেতরে নাম নিবন্ধের কাজ ছাড়া অন্য কিছু করতে পারছি না। আমাদের সামনে যাদের পাচ্ছি, তাদের ভোটার আইডি ও ছবিই আমরা নিবন্ধের জন্য লিখে রাখছি।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মাঈনুল হক ভুঞা বললেন, আমরা কেন্দ্রগুলোতে সর্বেচ্চ শৃঙ্খলা রাখার চেষ্টা করছি। পুলিশ এবং প্রশাসন সহযোগিতা করছে। আরও যাতে সুশৃঙ্খল হয় সেই চেষ্টা করবো আগামী দুইদিন।
সরকার সাত থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত নির্ধারিত ওএমএস কেন্দ্রে যারাই দাঁড়াবে, তাদেরকেই ওএমএস কার্ড দেবার জন্য নাম নিবন্ধিত করবে। একইসঙ্গে পাঁচ কেজি আটাও দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষামূলক ভাবে দেশের চারশ কেন্দ্রে দাঁড়ানো সুবিধাবঞ্চিতদের এর আওতায় নেওয়া হবে। এরমধ্যে সুনামগঞ্জের পাঁচটি কেন্দ্রে এই তালিকা করা হচ্ছে। প্রতিদিন তালিকায় নাম নিবন্ধন হয় ২৫০ জনের।

Explore More Districts