* খুলনার হাসপাতালে শতাধিক রোগী
* সারাদেশে বেড়েছে দশগুণ : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্টাফ রিপোর্টার ॥ পদ্মার এপারের গুরুত্বপূর্ণ ও সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী একশ’ ছাড়িয়েছে। এছাড়া এ হাসপাতালে চলতি বছরের বিগত সাড়ে সাত মাসে মোট রোগীর সংখ্যাও ছাড়িয়েছে সাড়ে পাঁচশ’। এভাবে সারাদেশের ন্যায় খুলনায়ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। খুমেক হাসপাতালের পাশাপাশি খুলনার সিভিল সার্জনো আওতাধীন জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও অবস্থান করছে ২২ ডেঙ্গু রোগী। এ জেলায় এ নিয়ে মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩জনে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, হঠাৎ করেই সারাদেশে দশগুণ ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেছে। আর এ কারণেই স্যালাইনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এজন্য পর্যাপ্ত স্যালাইন প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন প্রয়োজন হচ্ছে। মাস শেষে তা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১২ লাখ। গতকাল শনিবার মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিট পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, গতকাল সকাল পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘন্টায় এ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড থেকে চারজন রোগীকে ছাড়পত্র দেয়া হলেও ওই ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ২০জন। এ নিয়ে খুমেক হাসপাতালে গতকাল সকাল পর্যন্ত ভর্তি ছিলেন ১০২ জন রোগী। অর্থাৎ চলতি বছরের পয়লা জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত বিগত প্রায় সাড়ে সাত মাসে খুমেক হাসপাতালে ৫৫৭জন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অপরদিকে, খুলনার সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানবিদ মো: রেজওয়ান উল রাজ বলেন, বিগত ২৪ ঘন্টায় খুলনা জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দু’জন নতুন রোগী ভর্তি হলেও এসময় তিনজনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। এছাড়া একই সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার করা হয় একজনকে। গতকাল সকাল পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে মোট ২২জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, বিগত পয়লা জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত এ জেলায় মোট ১৩৩জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। যার মধ্যে চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র দেয়া হয় ১০৬জনকে এবং রেফার করা হয় পাঁচ জনকে।
গতকাল শনিবার মানিকগঞ্জের হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, যেহেতু এখন বর্ষা মৌসুম, বৃষ্টি-বাদলা হয়ে বিভিন্ন স্থানে পানি জমা হয়ে থাকছে। আর এ কারণে মশা বাড়ছে। তবে আশা করছি আগামীতে মশা কমে আসবে এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও কমে আসবে। ডেঙ্গু কমাতে হলে মশা কমাতে হবে। মশা কমলে ডেঙ্গু রোগী কমবে এবং সে জন্য নিয়মিত স্প্রে করতে হবে বেশি বেশি।
মানিকগঞ্জ হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিট পরিদর্শনের সময় সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক রেহেনা আক্তার, সিভিল সার্জন ডা. মোয়াজ্জেম আলী খান চৌধুরি, মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন, আবাসিক মেডিকেল অফিসার কাজী একেএম রাসেলসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
এদিকে, বাংলাদেশে এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুহার গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অস্বাভাবিক এ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এজন্য মশার বংশবিস্তারে দেশের অনুকূল পরিবেশকে দায়ী করেছে সংস্থাটি। শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর পয়লা জানুয়ারি থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৪৮৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এ জ্বরে ৩২৭ জন মারা গেছে। এর মধ্যে জুলাই মাসে ৬২ শতাংশ শনাক্ত এবং ৬৩ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার বেড়ে ০.৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ৫ বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও বাংলাদেশে ডেঙ্গু মহামারি, কিন্তু বর্তমান ডেঙ্গুর বৃদ্ধি অস্বাভাবিক এবং আগের বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এই ঢেউ শুরু হয়েছিল জুনের শেষের দিকে। আগের বছরের তুলনায় এ বছর এখন পর্যন্ত মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে বেশি।
প্রাক-বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার জরিপে দেখা যায় যে, মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য হটস্পটের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতা, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপটে কারণে সারা বাংলাদেশে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডব্লিউএইচও এর তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছর ২০২৩ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর অস্বাভাবিক বিস্তার শুরু হয়েছে যা এখনও অব্যাহত আছে। ২০০০ সাল থেকে রেকর্ড করা তথ্য অনুযায়ী একই সময়ের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ।
খুলনার পাশাপাশি বিগত ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৮৭ জনে।
এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৪৩২ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৮২ হাজার ৫০৬ জন।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের আহ্বান খুলনা নাগরিক সমাজের ঃ ক্রমবর্ধমানহারে বৃদ্ধি পাওয়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে ময়লা আবর্জনা, ঝোঁপ-ঝাড় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা, এডিস মশা নিধন ও এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছে খুলনা নাগরিক সমাজ।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সারা দেশের ন্যায় খুলনায়ও ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গু থেকে রেহাই পাওয়ার প্রধান উপায় এডিস মশা প্রতিরোধ করা। এডিস মশা প্রতিরোধ করতে হলে যেকোনো উপায়ে এর বংশবৃদ্ধি ঠেকাতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন এর প্রজননস্থল ধ্বংস করা। আর তা সম্ভব ময়লা-আবর্জনা, ঝোঁপ-ঝাড় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা, পানি জমতে না দেয়া, এর প্রজননস্থল চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ওষুধ ছিটানো যাতে লার্বা তৈরী হতে না পারে। সর্বোপরি এসব বাস্তবায়নে নাগরিকদের সচেতন করা। এ ব্যাপারে সংগঠনটির পক্ষ থেকে কেসিসি, স্বাস্থ্য বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বশক্তি নিয়োগের আহ্বান জানানো হয়। সংগঠনের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব অ্যাড. আ ফ ম মহসীন এবং সদস্য সচিব অ্যাড. মোঃ বাবুল হাওলাদার এক বিবৃতিতে আরও বলেন, সামগ্রিক কাজটি হতে হবে পরিকল্পিত অন্যথায় একদিকে যেমন রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হবে, অন্যদিকে এ রোগটি প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। নেতৃদ্বয় এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন এবং জনসাধারণকেও সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান।