থমথমে চবি, কর্তৃপক্ষের একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত – দৈনিক আজাদী

থমথমে চবি, কর্তৃপক্ষের একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত – দৈনিক আজাদী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি এখনো থমথমে। রোববার রাত থেকেই যৌথবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। গুরুতর আহত তিনজন শিক্ষার্থী আইসিইউতে রয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় রেফার করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থমথমে পরিবেশ : গতকাল সোমবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, জনজীবন স্বাভাবিক নয়। গেট সংলগ্ন বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ, এলাকাবাসীর উপস্থিতিও ছিল কম। গেটে যৌথবাহিনীর গাড়ি চোখে পড়েনি। তবে জোবরা গ্রামমুখী সড়ক ও ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে টহল ছিল।

গতকাল বিকালে অনুষ্ঠিতব্য কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের প্রভাষক নিয়োগ বোর্ড এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের দুটি বোর্ড স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে বিশেষজ্ঞরা ক্যাম্পাসে পৌঁছে যাওয়ায় বাংলা বিভাগের শিক্ষক পদোন্নতি বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়। একইসাথে গতকাল সব ধরনের একাডেমিক পরীক্ষা বন্ধ ছিল। ক্যাম্পাস সংলগ্ন ২ নং গেটের আশেপাশে কটেজ, মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে রোববার রাতে চবির আবাসিক হলে রাত যাপন করেন। তাদের জন্য শহিদ মিনারে খাবারের ব্যবস্থা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একটি অংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম জানান, ৩১ আগস্টের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

১৪৪ ধারা বহাল : ক্যাম্পাস এলাকায় জারি করা ১৪৪ ধারা গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত বহাল থাকার কথা থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেটা আজ মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্থানীয় গণ্যমান্যদের সাথে বৈঠক করে। সভায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ২১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। যাতে করে এলাকাবাসীর সাথে চবি শিক্ষার্থীদের আর কোনো সংঘাত ঘটতে না পারে।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় দুটি মামলা হবে : শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি মামলা দায়ের করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান বাদী হয়ে পৃথকভাবে দুটি মামলা করবেন হাটহাজারী মডেল থানায়। মামলা দায়ের করার উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আরো তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার জন্য কাজ চলমান রয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. কোরবান আলী।

প্রশাসনের জরুরি সিদ্ধান্ত : উপাচার্য, উপউপাচার্যদ্বয়, সকল ডিন, সিন্ডিকেট সদস্যদের উপস্থিতিতে গতকাল বিকালে জরুরি সভা করেন। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে উপাচার্য নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের জানান। সিদ্ধান্তগুলো হলো সংঘর্ষে আহত সকল শিক্ষার্থীর চিকিৎসার ব্যয়ভার প্রশাসন বহন করবে, যা গত দুদিনও বহন করে আসছে। এর জন্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় একটি মডেল থানা স্থাপনের বিষয়ে সরকারকে অনুরোধ করবে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় রেলক্রসিং এলাকায় একটি পুলিশ বঙ স্থাপনের ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। আজকের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করবে প্রশাসন।

সংঘর্ষের ঘটনা পর্যালোচনার জন্য আজ মঙ্গলবার একটি জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডাকা হয়েছে। জোবরা এলাকার বাড়িওয়ালাদের সাথে সমন্বয় করার জন্য একটি কমিটি করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রত্যাহার না করার অনুরোধ করেছে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য একটি হটলাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আইসিইউতে তিন শিক্ষার্থী : চবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২২২৩ সেশনের নাঈমুল ইসলাম, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ২০২০২১ সেশনের মো. মামুন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একই সেশনের ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েম গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে নাঈমুলকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় রেফার করা হয়েছে। পার্কভিউ হাসপাতালে মামুন ও সায়েমের দীর্ঘ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগামী ৭২ ঘণ্টা তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।

এছাড়া আহত অনেক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতলে ভর্তি আছেন।

সমাজতত্ত্ব বিভাগের ২০২০২১ সেশনের শিক্ষার্থী মো. মামুনের মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। নাকে, মুখে ও কানে আঘাত লাগে। ব্রেন হেম্পার হওয়ায় জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। তার মাথার খুলির ১৩ টুকরা হাড় অপসারণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে ফ্রিজে সংরক্ষিত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একই সেশনের ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েমের মাথায় গভীর কোপের কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। সাত ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পরও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। তিনি বর্তমানে লাইফ সাপোর্টে আছেন।

মামুনের সহপাঠী শাহাব উদ্দিন বলেন, ডাক্তাররা ভেবেছিলেন রক্ত জমাট অপসারণেই সমস্যা কেটে যাবে, কিন্তু দেখা গেছে মাথার ভেতরে হাড়ের টুকরা আটকে নতুন জটিলতা তৈরি করেছে। ফলে মাথার সম্পূর্ণ খুলি খুলে অপারেশন করতে হয়েছে। পর্যবেক্ষণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার খুলি বসানো যাবে না।

সমাজতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, মামুনের চার ঘণ্টাব্যাপী অপারেশনে ১৩ টুকরা হাড় বের করা হয়েছে। তার খুলি বর্তমানে ফ্রিজে সংরক্ষিত আছে এবং সুস্থ হলে দুই মাস পর সেটি পুনঃস্থাপন করা হবে।

পার্কভিউ হাসপাতালের জিএম বলেন, প্রথমে সায়েমের অপারেশন করা হয়। তবে তার জ্ঞানের স্তর এখনো ৬৭ এর মধ্যে। তিনি লাইফ সাপোর্টে আছেন এবং প্রেসার কৃত্রিমভাবে ১২০/৭০এ রাখা হয়েছে। মামুনের অবস্থাও গুরুতর, তবে সামান্য সাড়া দিচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ নিয়াজ মোরশেদ জানান, সায়েমের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। আমরা নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছি এবং সবার কাছে দোয়া চাই।

৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব পরীক্ষা স্থগিত : চবির বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকল বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ২ তারিখ থেকে আগামী ৪ তারিখ পর্যন্ত আমরা সকল বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছি। তবে বিভাগ ও ইনস্টিটিউট যদি শতভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে তাহলে বিভাগীয় কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে পরীক্ষা নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।

এ সময় ক্লাস বন্ধ থাকবে কিনা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শতভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতির ভিত্তিতে বিভাগ চাইলে পরীক্ষা নিতে পারবে। তবে পরীক্ষা না হলেও যেসব বিভাগে পরীক্ষা নেই সেসব বিভাগগুলোতে ক্লাস চলমান থাকবে।

নারী শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ : চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহ্‌ইয়া আখতারের রোববার রাতে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল বিকালে শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিল করেন নারী শিক্ষার্থীরা। তারা প্রশাসনের ভূমিকা ও উপাচার্যের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান।

এক শিক্ষার্থী বলেন, চবি মেডিকেলের তথ্যমতে ১৫শ শিক্ষার্থী আহত হলেও ভিসি বলছেন মাত্র ২শ জন আহত। আমাদের ভাইয়েরা রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে, আর তিনি শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন। উপাচার্যের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

আরেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ভিসি বলছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তাকে বারবার ফোন দিয়েছেন, তাতেই তিনি খুশি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের রক্ষায় যথাসময়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি এই প্রশাসন। আমরা উপাচার্যের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

ছাত্রশিবিরের সংবাদ সম্মেলন : গতকাল দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলন করে শাখা ছাত্রশিবির। সংবাদ সম্মেলনে শাখা সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, গত শনিবার রাতে এবং রোববার দিনব্যাপী চবি শিক্ষার্থীদের উপর স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হাটহাজারী পুলিশ প্রশাসন এবং দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নীরব ভূমিকা পালন করেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সংবাদ সম্মেলনে ৪ দাবি উত্থাপিত করেন। দাবিসমূহ হলো প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সকল সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং পুরো এলাকা অস্ত্রমুক্ত করতে হবে। ক্যাম্পাসের স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি রাখতে হবে। এ সময় ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ইব্রাহিম হোসেন রনি, শাখা সেক্রেটারি মোহাম্মদ পারভেজ উপস্থিত ছিলেন।

চবি শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা

চবি ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ : শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। নেতৃবৃন্দ হামলায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। এ সময় বক্তব্য দেন শিবিরের প্রচার সম্পাদক ইসহাক ভূইঁঞা, কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য ইব্রাহিম হোসেন রনি ও চবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী।

হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুরে জোবরা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ওই এলাকার বাছাইয়ের দোকানের আশপাশে অনেক বাড়িঘরের সিঁড়িঘর ও বিল্ডিংয়ের জানালার কাচ, বাড়ির টিনের ঘেরা, দোকানপাটের দরজা ক্ষতবিক্ষত।

কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, এমন পরিস্থিতি কারো কাম্য নয়। আমরা এলাকা এবং চবি ক্যাম্পাসের সুন্দর একটা পরিবেশ চাই, শান্তি চাই। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হোক।

Explore More Districts