বহুকাল আগের কথা। দূর পাহাড়ে সাধনা করতেন একজন সাধক। সবাই তাকে গুরুজী বলেই সম্বোধন করতো। পুণ্যধন ও দেমখুলা নামে তাঁর দু’জন শিষ্য ছিল। পূণ্যধন ছিল সৎ, শান্ত, জ্ঞানী ও পরোপকারী। অন্যদিকে দেমখুলা ছিল ঠিক তার উল্টো।
দীর্ঘদিন গুরুজীর সান্নিধ্যে থেকে পূণ্যধন নিজেকে মানুষের সেবায় বিলিয়ে দেবার ধ্যান অর্জন করে। কিন্তু দেমখুলা চায় মানুষের উপর কর্তৃত্ব। সে চায় তার জ্ঞানের উল্টো প্রয়োগে মানুষকে শোষণ করতে। দেমখুলা গুরুজী’র অমূল্য সম্পদ গুপ্তধনের সন্ধানে উদগ্রীব। অন্যদিকে ধুপপুরি আর পূণ্যধন পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু সেখানেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় দেমখুলা। সে ধুপপুরিকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে চায়। ঘটনাচক্রে একদিন দেমখুলা পূণ্যধনের সাথে যেচে ঝগড়া বাঁধায়। দেমখুলা উল্টো গুরুজী’র কাছে পূণ্যধনের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করে। গুরুজী ন্যায়সঙ্গত বিচার করতে চাইলে দেমখুলা সেই বিচারকে অবজ্ঞা করে এবং গুরুজীসহ সবাইকে তার শত্রু রূপে গণ্য করে। শুরু করে দেমখুলা তার প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের পালা।
এই কাহিনী উপর নির্মিত তৈনগাঙ থিয়েটার এর ১ম প্রযোজনা তঞ্চঙ্গ্যা নাটক-মন’উকূলে। তরুণ নাট্যকার রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যার গল্প অবলম্বনে নাটকটির নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দেন প্রতিভাবান নাট্যকার আশিক সুমন।
গত ১৩ এপ্রিল কাপ্তাইয়ের তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বিষু উৎসবে ওয়াগ্গা জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহার মাঠে রাত ৮ টায় এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এটা ছিল এই নাটকের তৃতীয় প্রযোজনা। এর আগে নাটকটির প্রথম প্রযোজনা রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় দ্বিতীয় প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়।
নাটকের পুণ্যধন চরিত্রে রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যাার অনবদ্য অভিনয় মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের। এছাড়া ধুপপুরি চরিত্রে সুবিতা তঞ্চঙ্গ্যা ও দেমখুলা চরিত্রে বিশ্বজিৎ তঞ্চঙ্গ্যার সাবলীল অভিনয় শৈলী দর্শকরা মনে রাখবে অনেকদিন।
গগণ চরিত্রে প্রদীপ্ত তঞ্চঙ্গ্যা, দুষ্টসেবক চরিত্রে বিশাল তঞ্চঙ্গ্যা ও গুরুজীর চরিত্রে বিনয় কান্তি চাকমার অভিনয় হাজার খানেক দর্শক উপভোগ করেন তুমুল করতালিতে।
এই বিষয়ে আরও
নাটক দেখতে আসা তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট ব্যাংকার অমল বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা জানান, আমাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজস্ব ভাষার নাটক, গান পরিবেশন খুবই জরুরী। আজকের নাটকের সকলের প্রানবন্ত অভিনয় সত্যি মুগ্ধ করেছে আমাদেরকে।
বিষু উৎসব উদযাপন কমিটির আহবায়ক ও রাঙামাটি জেলা পরিষদ সদস্য দীপ্তিময় তালুকদার জানান, নাটকের প্রত্যেকটি চরিত্র নিপুণ অভিনয় শৈলীর মাধ্যমে তাঁরা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
নাটকটির নির্দেশক, মঞ্চ ও আবহ সঙ্গীত পরিকল্পক আশিক সুমন জানান,‘তৈনগাঙ থিয়েটার’ তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার একটি সম্ভাবনাময় নাট্যদল। যারা স্বপ্ন দেখে থিয়েটারকে সঙ্গী করে নতুন কোন দিগন্ত উন্মোচনের।
‘মন’উকূলে’ নাট্যদলটির প্রথম প্রযোজনা। এই নাটকটিতে নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় আমাকে সম্পৃক্ত করার জন্য ‘তৈনগাঙ থিয়েটার’ এর স্বপ্নদ্রষ্টা রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা’র কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার নাট্যযাত্রায় আরও একটি নতুন পথ সৃষ্টি হলো। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা’র গল্পে ‘মন’উকূলে’ নাটকটি আমাদের মনুষত্ব্যের দুয়ারে আরও একটিবার কড়া নাড়বে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রসঙ্গত: ‘ তৈনগাঙ থিয়েটার’ তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার একটি নাট্যদল। ১৪ শতকের দিকে আরাকান রাজ্যের পর এ অঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর আদিনিবাস ‘তৈনগাঙ’ এর নামানুসারে থিয়েটার এর নামকরণ।
“তৈনগাঙ থিয়েটার”পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্যময় সংস্কৃতিকে থিয়েটারের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চায়। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় থিয়েটারের মাধ্যমে মানুষকে উজ্জীবিত করতে চায়। “মন’উকূলে” নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষের মানবিক বোধগুলোর প্রচ্ছন্ন ছবিগুলো কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁরা।