ট্রলার বোঝাই করে আসছে ইলিশ

ট্রলার বোঝাই করে আসছে ইলিশ

ট্রলার বোঝাই করে আসছে ইলিশ

গভীর সমুদ্রে জাল ফেলতেই জেলেদের জালে ধরা পড়ছে বড় সাইজের রূপালি ইলিশ। জেলেদের আহরিত এসব ইলিশ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। এতে খুশি জেলেসহ মৎস্যজীবীরা। দক্ষিণাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুরে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার মণ ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে। যার মূল্য প্রায় ৪০-৪৫ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে মৎস্যবন্দর সূত্র।

এভাবে সাগরে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়লে কেটে যাবে জেলেদের দুঃখ দুর্দশা। ফিরে আসবে মৎস্য খাতে সুদিন। দেশের বাজারে ইলিশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

দীর্ঘ ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে তিন দফায় গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের উদ্দেশে গিয়ে বৈরী আবহাওয়ার কারণে খালি হাতে তীরে ফিরে আসতে হয়েছে জেলেদের। এতে অনেকটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন মৎস্যসংশ্লিষ্টরা। আবহাওয়া অনুকূলে আসলে ফের ১২ আগস্ট গভীর সমুদ্রে ইলিশ শিকারের উদ্দেশে যায় সহস্রাধিক জেলে ট্রলার। মাছ শিকার শেষে বেশির ভাগ ট্রলারই ঘাটে ফিরেছে রূপালি ইলিশ নিয়ে। ৭০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা দরে। প্রতিটি ট্রলারে ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। জেলেদের আহরিত এসব ইলিশ বরফ দিয়ে ককশিট ভরে পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন মোকামে। বরফ কলগুলোতেও বরফ উৎপাদন বিকিকিনি চলছে হরদম।

সাগরে কাক্সিক্ষত ইলিশ ধরা পড়ায় স্বস্তি ফিরেছে জেলেসহ মৎস্যসংশ্লিষ্টদের মাঝে। তবে গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ভারতীয় জেলেরা অবাধে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। গভীর সমুদ্রে নৌবাহিনীর টহল জোরদারের দাবি জানান মৎস্যজীবীরা। এদিকে বাজারে ইলিশ আসায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে মৎস্য আড়তগুলোতে। বিক্রিও হচ্ছে চড়া দামে। তবে গভীর সমুদ্রে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ ধরা পড়লেও সমুদ্র উপকূল ভাগে মাছ শিকাররত জেলেদের জালে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ তেমন একটা ধরা পড়ছে না বলে দাবি মৎস্য আড়তদারদের।
মৎস্যবন্দর মহিপুরের এফবি সুমি আকতার ট্রলারের মাঝি কামরুল ইসলাম প্রকাশ কালু জানান, গভীর সমুদ্রে ৮ দিন মাছ শিকার শেষে বড় সাইজের ৩ হাজার ইলিশ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সকালে তিনি আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এসে পৌঁছান। তিনি জানান, ৩ হাজার পিস ইলিশের প্রায় ৫০ মণ ওজন। যার মূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

মায়ের দোয়া-২ ট্রলারের মাঝি মো. ফরিদ জানান, বৈরী আবহাওয়া শেষে মাছ শিকারে গভীর সমুদ্রে যান তারা। ১০ দিন সমুদ্রে ছিলেন। দশ দিনে ৩০ মণ ইলিশ ধরা পড়েছে তার জালে। যার দাম প্রায় ৩০ লাখ টাকা বলে জানান তিনি। একই কথা জানান, এফবি শুভ সকাল ট্রলারের মাঝি জহিরুল ইসলাম। এভাবে গভীর সমুদ্রের প্রতিটি ট্রলার ইলিশ পেয়েছে।

তবে এসব জেলেদের দাবি, বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেরা অবাধে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে কোনো বাধা ছাড়াই। সমুদ্রে ভারতীয় ট্রলারের কারণে জাল ফেলার জায়গা পাচ্ছেন না দেশীয় জেলেরা। এমন অভিযোগ গভীর সমুদ্রে মাছ শিকাররত প্রতিটি ট্রলারের জেলেদের। এসব জেলেদের দাবি, নৌবাহিনীর টহল জোরধার করার মাধ্যমে ভারতীয় জেলেরা বঙ্গোপসাগরে যাতে প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা হলে ইলিশে সয়লাব হয়ে যাবে দেশীয় বাজার।

মহিপুর মৎস্যবন্দরের মৎস্য ব্যবসায়ী ও নদী ফিসের মালিক মো. নজরুল ইসলাম নজির জানান, তার আড়তে গত ৪-৫ দিনে যেসব ট্রলার ইলিশ নিয়ে এসেছে প্রতিটি ট্রলারে ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করেছে।

মেসার্স হাওলাদার ফিসের মালিক মো. জলিল হাওলাদার বলেন, গভীর সমুদ্রে অনেক ইলিশ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। প্রতিটি ট্রলার কমবেশি ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরছে। তার তথ্যমতে, মহিপুর মৎস্যবন্দরে একটি ট্রলার সর্বোচ্চ ৯৬ লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করেছে।

মহিপুর মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ রাজা জানান, গভীর সমুদ্রে অনেক ইলিশ দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি ট্রলারই ইলিশ নিয়ে ফিরছে। এসব ট্রলার ২০ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা বিক্রি করছে। এর কমবেশিও আছে। তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রে ইলিশ ধরা পড়লেও উপকূল ভাগে ইলিশ খুবই কম। উপকূল ভাগের জেলেরা দেনায় জর্জরিত। কোনোমতে জীবন চলছে তাদের।

তিনি আরো জানান, বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় ট্রলার অনুপ্রবেশ করে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। তা না হলে আমাদের জেলেরা ট্রলারবোঝাই করে ইলিশ নিয়ে ঘাটে আসত। এসব বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বারবার অবহিত করলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না জেলেরা। এভাবে চলতে থাকলে সমুদ্র মাছশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন আড়তদার সমিতির এই নেতা।

আলীপুর-কুয়াকাটা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, গভীর সমুদ্রে জেলেদের জালে বড় সাইজের ইলিশ ধরা পড়লেও তা পর্যাপ্ত নয়। আর সব ট্রলারে ইলিশ পাচ্ছে না। কিছু কিছু ট্রলার ইলিশ পাচ্ছে। তবে ইলিশ কম ধরা পড়লেও দাম ভালো পাওয়ায় জেলেদের পুসিয়ে যাচ্ছে। তার দাবি, গভীর সমুদ্রে ইলিশের দেখা মিললেও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ইলিশের আকাল এখনো রয়েছে। ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলারে পোয়া, ডাডি, ফাহাসহ বিভিন্ন প্রকারের সাদা মাছ পেলেও তা পরিমাণে খুবই কম।

তিনি বলেন, এক একটি ট্রলারে তেল, বরফসহ ১ লাখ টাকার উপরে খরচ হয়। বিক্রি করছেন ৫০ হাজার টাকা। ট্রলারমালিক ও আড়তদাররা অনেকেই লোকসান গুনছেন। তবে সামনে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়বে এমনটাই প্রত্যাশা এই মৎস্য আড়তদার সমিতির নেতার।

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, জলবায়ুর ইতিবাচক প্রভাব ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলেদের জালে কাক্সিক্ষত ইলিশ ধরা পড়ছে। ফের সাগরে গেলে বড় আকারের প্রচুর ইলিশ ধরা পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। কুয়াকাটা পৌরসভাসহ কলাপাড়া উপজেলায় নিবন্ধিত প্রায় ১৯ হাজার জেলে রয়েছে। এসব জেলেরা ফের সমুদ্রে গেলে জেলেদের জালে ধরা পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালি ইলিশ। হাসি ফুটে উঠবে জেলেদের মুখে- এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

এআই

Explore More Districts