মোস্তাফিজুর রহমান: সবাই মনে করেছেন, একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে। সবাই ভেবেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগে ভাটা, বৈষম্য—দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এসব সমস্যা হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার খুব দ্রুত সমাধান করে ফেলতে পারবে; কিন্তু এটা বাস্তবে সম্ভব নয়। সেটা সম্ভবও হয়নি। প্রত্যাশার চাপ ও পুঞ্জীভূত চাপ দুটো মিলিয়েই সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে। সাপ্লাই চেইনে বড় ধরনের বিচ্যুতি হয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কম হয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়েছে, বিনিয়োগে স্তিমিত ভাব দেখা গেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়নি। প্রথম প্রান্তিকে এই প্রবণতাটা দেখা গেছে; কিন্তু ইতিবাচক ব্যাপারটা হচ্ছে, সর্বসাম্প্রতিক মাসগুলোতে উত্তরণটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, সর্বনিম্ন জায়গায় নেমে যাওয়ার পর আমরা আবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছি। আমরা দেখছি, প্রবাসী আয় ভালো আসছে। এখানে নিঃসন্দেহে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অবদান আছে। আবার বৈধ পথে টাকা পাঠালে যে দেশের কাজে লাগবে, হুন্ডি-হাওলা যে ভালো নয় এবং এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ, করখেলাপি, ঋণখেলাপি, রাজনীতিবিদদের একটা অংশ দেশ থেকে টাকা পাচার করে ফেলে—এখান থেকে প্রবাসীদের বের করে আনার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসীদের মধ্যে নিজেদের একটা পরিষ্কার ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছে। এর ফলে আমরা দেখেছি সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসছে।
আমাদের রপ্তানিকারকেরা এত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ১২ শতাংশের মতো রপ্তানি প্রবৃদ্ধি করেছেন। রপ্তানির মাধ্যমে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং আমদানির মাধ্যমে ওভার ইনভয়েসিংয়ের প্রবণতাটা স্তিমিত হয়েছে। এর ফলে বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের জায়গাটা স্থিতিশীল হয়েছে। এটা একটা বড় ঘটনা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেও স্থিতিশীল করা গেছে। এতে বিনিময় হারটা স্থিতিশীল হয়েছে। এর ফলে আমদানি করা মূল্যস্ফীতির উচ্চ চাপটা সুস্থির অবস্থায় এসেছে।
এ ছাড়া আমদানির ওপর বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাটি শিথিল করা গেছে। আমদানিও কিছুটা চাঙা হচ্ছে। শীতকালীন সবজির সরবরাহ ভালো; কিন্তু চালের দামটা ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের সময়মতো চাল আমদানি করতে হবে, চালের পর্যাপ্ত মজুত করতে হবে। ওএমএস, ফ্যামিলি কার্ড বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতির চাপটা কিছুটা নিম্নমুখী হলেও মূল্যস্তরটা ওপরের দিকে আছে। এর ফলে ক্রয়ক্ষমতার যে অবনমন, সেটা অব্যাহত আছে। বিশেষ করে মজুরি হার বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি হারের বৃদ্ধির গড়টা বেশি।
সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জের জায়গাটা হলো বিনিয়োগটাকে আবার চাঙা করা। কিন্তু এখানে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কেননা, ব্যাংকিং খাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে উদ্যোক্তাদের উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। সরকার হয়তো যুক্তি দিতে পারে, আগের সরকারের আমলের ভুল নীতির খেসারত তাদের দিতে হচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে উদ্যোক্তা ও ভোক্তাকেই তো বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে।