ঝিনাইদহে ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ, শতকোটি টাকা বিক্রির আশা

ঝিনাইদহে ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ, শতকোটি টাকা বিক্রির আশা

রাত পোহালেই পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এরই মধ্যে বসন্ত উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও সারাদেশে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায়। এই তিন দিবসকে ঘিরে সারা দেশে ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঝিনাইদহের ফুলচাষিরা এখন ফুল পরিচর্যা, সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এই তিন দিবসে অন্তত ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবে এমনটি আশা করছেন জেলার ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, যশোরের পরেই দেশের বৃহত্তম ফুল উৎপাদনকারী জেলা ঝিনাইদহ। জেলার ৬ উপজেলার মধ্যে চারটিতেই গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, টিউলিপ, থাই গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধসহ বাহারী রঙের ফুলের চাষ হচ্ছে প্রায় তিন দশক ধরে। বছরের এই সময়কে টার্গেট করে থাকেন চাষিরা। বসন্ত বরণ, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুন। তাই ভালো ফলন পেতে শেষ সময়ে ফুল বাগানে চলছে পরিচর্চা। করা হচ্ছে আগাছা দমন, সেচ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ। বাজারে সব ধরণের ফুলের দাম প্রথম থেকেই কম রয়েছে। তবে আগামী দিবসগুলোতে চড়াদামে ফুল বিক্রি করতে পারলে, সারা বছরের খরচ পুষিয়ে লাভবান হবেন ফুল চাষীরা। রং, আকৃতি আর গন্ধের কারণে এই অঞ্চলের ফুলের চাহিদা বেশি।

বিজ্ঞাপন



সরেজমিনে ঝিনাইদহের সদর উপজেলার গান্না, কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা, মহেশপুর উপজেলার নেপা বাজারের পাইকারি ফুলের বাজারে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই চাষিরা নেমে পড়েন ক্ষেতে। গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাসসহ নানা জাতের ফুল সংগ্রহের কাজ চলে টানা দুপুর পর্যন্ত। এরপর ফুলগুলো ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না, কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা, মহেশপুর উপজেলার নেপা বাজারে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়। এই ফুলগুলো হাত বদলে পৌঁছে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। সারাদেশে গাঁদা ফুলের ৭০ শতাংশ চাহিদা মিটে থাকে ঝিনাইদহ থেকে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ঝিনাইদহ জেলায় এবার ২২৪ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ২৭ হেক্টর, কালীগঞ্জে ৭৫ হেক্টর, কোটচাঁদপুরে ৫২ হেক্টর এবং মহেশপুর উপজেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে নানা প্রজাতির ফুল চাষ হয়েছে। তবে জেলার সদর উপজেলা ও কালীগঞ্জে গাঁদা ফুলের চাষ বেশি হয়ে থাকে। হলুদ ও লাল রঙের এই ফুল সারাদেশে বেশ জনপ্রিয়।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের চান্দের পোল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে ফুলের চাষ করেন সোলাইমান হোসেন ও তার বাবা। নতুন করে এক বিঘা জমিতে জারবারা ফুলের চাষ করেছেন। বর্তমানে ১ একর জমিতে চন্দ্রমল্লিকা, জারবারা, গোলাপ ও গাঁদা ফুলের চাষ করেন। এসময় দেখা যায়, সামনে বিশেষ দিবসকে ঘিরে ফুল গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে সোলাইমান ও তার বাবা। অন্যদিকে শ্রমিক দিয়ে চন্দোমল্লিকা বাগান থেকে ফুল উঠানো হচ্ছে বিক্রয়ের জন্য। গোলাপ বাগানে ফুলে ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়েছে। জারবারা শেডেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি যত্ন, যেন আগামী দিবসে বাড়তি দামে বাগানের ফুলগুলো বিক্রি করতে পারে।



জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ঝিনাইদহে ২২৪ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা ২৭ হেক্টর, কালীগঞ্জে ৭৫ হেক্টর, কোটচাঁদপুরে ৫২ হেক্টর এবং মহেশপুরে ৭০ হেক্টর। এর মধ্যে সব থেকে ঝিনাইদহ ও কালীগঞ্জে গাঁদা ফুলের চাষ বেশি হয়ে থাকে। আর এই ফুল সারাদেশের মধ্যে বিখ্যাত।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না গ্রামের ফুলচাষি সোলাইমান হোসেন বলেন, এক একর জমিতে চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, গোলাপ ও গাঁদা ফুলের চাষ করেছি। বিশেষ দিবসকে ঘিরে ফুল গাছের পরিচর্যায় আমাদের ব্যস্ত সময় কাটছে। বাজারে ফুলের দাম বেশি।

ফুল চাষি শরিফুল ইসলাম বলেন, সারা বছর গাঁদা ও গোলাপ ফুলের চাহিদা স্বাভাবিক থাকে। তবে ডিসেম্বর থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিশেষ দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে ফুলের বাড়তি যত্ন নেওয়া হয়। গতবছর ফুলের বাজার অনেক ভালো ছিল, এ বছর একটু কম। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি, বসন্ত বরণ ও ২১শে ফেব্রুয়ারি ফুলের দাম বেশি পাবো বলে আশা করছি।

গান্না বাজারে ফুল ব্যবসয়ী সোহাগ হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন আগেও ফুলের বাজার অনেক কম ছিল। বর্তমানে ফুলের চাহিদা বেড়েছে। আর ঝিনাইদহের গাঁদা ফুল সারাদেশে বিক্ষাত। আজকের ফুলের বাজার গাঁদা ফুল মান ভেদে ২৫০ টাকা থেকে ৩৬০ টাকা ঝুপা, গোলাপ ২০ থেকে ২৫ টাকা পিস, জারবারা ৮ থেকে ১০ টাকা পিস, রজনীগন্ধা ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা পিস, গ্ল্যাডিওলাস ১০ থেকে ১২ টাকা পিস পাইকারি বিক্রয় হয়েছে।



কালীগঞ্জের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুলচাষি টিপু সুলতান বলেন, ভালোবাসা দিবসে গোলাপ ও রজনীগন্ধা, ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে গাঁদা ফুল বেশি বিক্রি হয়। এ জন্য এখন ফুলের পরিচর্যা করছি।ফুলের মান ধরে রাখতে এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে ভিটামিন ও কীটনাশক নিয়মিত ব্যবহার করছি। এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় ফুলের উৎপাদন অনেক বেশি হয়েছে। প্রথম দিকে দাম কম থাকলেও যত দিন যাচ্ছে ফুলের দামও ততই বাড়ছে। আশা করছি এ বছর ভালো দামে ফুল বিক্রি করতে পারব।

রেজাউল ইসলাম নামের আরেক ফুলচাষি বলেন, আমি দেড় বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করেছি। আমার বাগানের গোলাপগুলো লংস্টিক এবং লাল, সাদা, হলুদ, কমলা ও গোলাপি রঙের। এ রঙের ফুল ভালোবাসা দিবসে অনেক বেশি কদর থাকে। এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদন অনেক বেশি হয়েছে। গতবারের চেয়ে এ বছর ফুলের দাম ভালো পাব।

জেলা ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি জমির উদ্দিন জানান, গত কয়েকদিন আগেও ফুলের বাজারে দাম অনেক কম ছিল। বর্তমানে ফুলের চাহিদা বেড়েছে। ঝিনাইদহের গাঁদা ফুল সারাদেশে জনপ্রিয়। বর্তমানে প্রতি ঝুপা (গোছা) গাঁদা ফুল মান ভেদে ২৫০ টাকা থেকে ৩৬০ টাকা, গোলাপ প্রতি পিস ১৮-২০ টাকা, জারবেরা প্রতি পিস ৮-১০ টাকা, রজনিগন্ধা প্রতি পিস ৬-৭ টাকা, গ্লাডিওলাস প্রতি পিস ১০-১২ টাকায় পাইকারি বিক্রয় হচ্ছে।



জমির উদ্দিন আরও বলেন, পহেলা ফাল্গুন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। এসব দিবসকে ঘিরে ঝিনাইদহ থেকে আনুমানিক অন্তত ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবো বলে আমরা আশা করছি।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূর-এ-নবী বলেন, ঝিনাইদহে ফুল চাষীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। আশা করছি এ বছর সদর উপজেলার গান্না বাজার থেকে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে। আমরা ফুলের পরিচর্যা, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দিয়েছি। আশা করছি, এ বছর কৃষকরা লাভবান হবেন।

ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, সারা দেশের ফুলের চাহিদা মেটাচ্ছেন ঝিনাইদহের চাষিরা। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের নিয়মিত দেখভাল করা হচ্ছে। এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকার জন্য চাহিদার চেয়ে বেশি ফুল উৎপাদন হয়েছে এ জেলায়। আশা করছি ফুল চাষিরা অন্যবারের চেয়ে এবার বেশি টাকার ফুল বিক্রি করবে।

Explore More Districts