“জয় বাংলা” স্লোগানের উৎপত্তি ও বর্ণনা

“জয় বাংলা” স্লোগানের   উৎপত্তি ও বর্ণনা

অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ
স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে “জয় বাংলা” স্লোগানটি এক নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। “জয় বাংলা” এমন একটি স্লোগান যা মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণকে তাদের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবলভাবে ঐক্যবদ্ধ করে তুলে। এর আগে বাঙালি আর কখনো এতো তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি।
“জয় বাংলা” স্লোগানটি ছিল সশস্ত্র যুদ্ধকালীন সময় বাঙালির প্রেরণার উৎস। যুদ্ধ জয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে চারপাশের জনগণকে বিজয়ের বার্তা পৌঁছে দিতো। কখন কিভাবে “জয় বাংলা” স্লোগানটির উৎপত্তি হয় তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হলো।
১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সাল সেদিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা ছিলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সেই সভায় আলোচনার এক পর্যায়ে তৎকালীন রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ এবং দর্শন বিভাগের ছাত্রলীগ নেতা কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক চিশতী শাহ হেলালুর রহমান (৭১ এ শহীদ) “জয় বাংলা” স্লোগানটি সর্ব প্রথম উচ্চারণ করে। সঙ্গে সঙ্গে আরো সাত আট জন কমীর্ “জয় বাংলা” স্লোগান দিতে থাকে। এই দুই নেতাই ছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য।
১৮ই জানুয়ারি ১৯৭০ সাল ঢাকা শহরের পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় সিরাজুল আলম খান সর্ব প্রথম জয় বাংলা স্লোগানটি জনসভায় উচ্চারণ করেন। উপস্থিত সকলেই স্লোগানটি গ্রহণ করে নেয়। ১লা জুন ১৯৭০ সাল রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু এ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন, “জয় বাংলা”, গোপন সংঘটন নিউক্লিয়াসের বিবেচনায় আসে। নিউক্লিয়াসের পক্ষ থেকে স্লোগান নির্ধারণের জন্য তিনটি সেলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে “জয় বাংলা” স্লোগানটি অনুমোদন দেয়া হয়। পাশাপাশি বলা হয় ঐ স্লোগানটি অত্যান্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহারের জন্য।
৪ঠা জানুয়ারি ১৯৭০ সাল। সেদিন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে “জয় বাংলা” স্লোগান দেয়া শুরু হলে দুয়েকজন আপত্তি করেন এবং স্লোগানটি বন্ধ রাখার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনুরোধ জানান। তার পরেও বার বার “জয় বাংলা” স্লোগানটি উচ্চারিত হতে থাকে।
নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক উইং হিসাবে বি.এল.এফ গঠন করা হয়। বি.এল.এফ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বি.এল.এফ এর মূল দায়িত্বে ছিল কাজী আরেফ এবং মনিরুল ইসলাম।
১৮ই জানুয়ারি ১৯৭০ সাল। এ দিনটি ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক সন্ধিক্ষণ। জনসভা শুরু হওয়ার ১০/১৫ মিনিট আগে “জয় বাংলা” স্লোগানটি রং তুলিতে কাঠের খন্ডে লিখেছিলেন শিল্পী কামাল আহমেদ। প্রত্যেকটি খঁুটির কাছে ছিল দুইজন করে বি.এল.এফ কমীর্। মঞ্চটি ছিল বেশ উঁচু। মঞ্চের শামিয়ানায় আটকানো হার্ডবোর্ডের উপর কাঠের খন্ডে উজ্জ্বল লাল রংয়ের দুটি শব্দ “জয় বাংলা” জ্বলজ্বল করছিল।
সভার শুরুতে তাজউদ্দিন আহমেদ বক্তব্য রাখেন। সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, খুনী মোশতাক, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, গাজী গোলাম মস্তফা। আরো একজন অপরিচিত লোক মঞ্চে বসছিল। তিনি হলেন সিরাজুল আলম খান। বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে বলে উঠেন, সিরাজ তুমি স্লোগান দাও। সিরাজুল আলম খান মাইকের কাছে এলেন এবং আবেগের সহিত বলে উঠেন আপনারা দেখছেন উপরে জ্বল জ্বল করছে দুই শব্দ “জয় বাংলা”। আসুন সাত কোটি মানুষের পক্ষ হয়ে সকলকে জানিয়ে দিতে চাই বাঙালি আমাদের পরিচয়। আসুন যার যতো জোর আছে সবটুকু দিয়ে উজাড় করে বলে উঠি “জয় বাংলা”, বাঙালি জাতির পরিচয়ের এক শব্দ “জয় বাংলা”। সেই থেকে বাংলাদেশের জনগণ প্রথম জানালো তাদের আগামী দিনের মুক্তির স্লোগান “জয় বাংলা”। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্য “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়েই শেষ করেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সভা থেকে লক্ষ কন্ঠে ধ্বনিত হলো “জয়বাংলা”। এ গর্জন বিকেলের শীতল বাতাস বয়ে নিয়ে গেল গোটা ঢাকা শহরে। এ যেনো নবজাগরণের ইঙ্গিত। “জয় বাংলা” শুধু একটি স্লোগান নয়— একটি ইতিহাস সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের নাম। এ স্লোগান ৭১ এ বাঙালি জাতিকে করেছিল ঐক্যবদ্ধ আর সশস্ত্র যুদ্ধকে করেছিলো জয়।
লেখক : যুদ্ধকালীন কোম্পানী কমান্ডার

Explore More Districts