শেফালী ঘোষ নামটি উচ্চারণ করলে একবাক্যে সবাই চিনেন, কে এই শেফালী ঘোষ। তিনি আর কেউ নন, আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী। আঞ্চলিক গানের একজন কিংবদন্তি শিল্পী ছিলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে আঞ্চলিক গান বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। লাখো ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন তিনি। ১৯৪১ সালের ১১ জানুয়ারি বোয়ালখালী উপজেলার আমুচিয়া ইউনিয়নের কানুনগোপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কৃষ্ণ গোপাল ঘোষ ও মাতা আশালতা ঘোষ। শৈশব কেটেছে বোয়ালখালীতে। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শেফালী ঘোষ স্থানীয় মুক্তাকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন পরিবারের অনুপ্রেরণায় গান গাওয়ার আগ্রহ জাগে। সেই থেকে গান গাইতে গাইতে এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী হয়ে উঠেন তিনি। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যসহ ২০টির বেশি দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। বিশ্বের দরবারে চট্টগ্রামকে তুলে ধরেছেন অনন্য মর্যাদায়।
প্রায় পাঁচ দশকের সংগীতজীবনে সহস্রাধিক গান গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া গান নিয়ে দুই শতাধিকের বেশি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। একসময় চট্টগ্রামের মানুষ শেফালী ঘোষ ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানের কথা কল্পনাও করতে পারেনি। সেই সময়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের আরেক জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। তখন শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব জুটি গড়ে তোলেন। তাদের গান তখন গ্রাম–বাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত।
শেফালী ঘোষের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা, নাতিন বড়ই খা, ও বানু বানুরে, সূর্য উডের অভাই লাল মারি,/ রইস্যা বন্ধু যারগই আমার বুকে ছেল মারি, ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত,/ লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী, নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি আইস্য তাড়াতাড়ি,/ তোঁয়ারে ছাড়া খাইল্যা ঘরত থাইক্যুম কেন গরি?। এসব গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে শেফালী ঘোষকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে, যার কারণে যে কোনো পালাগান, অনুষ্ঠান শেফালী ঘোষ ছাড়া হতো না।
গ্রামে–গঞ্জে ছেলে–বুড়ো–যুবক সবার মুখে ছিল শেফালীর গান। উপমহাদেশখ্যাত রমেশ শীল, আবদুল গফুর হালী, কবিয়াল এয়াকুব আলী, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত দাশ, মোহন লাল দাশের রচিত গান গেয়েও সুনাম কুঁড়িয়েছেন তিনি। তাই তো তাঁর মৃত্যুর ১৭ বছর পার হয়ে গেলেও আজো তাঁকে ভুলেনি চট্টগ্রামবাসী। এই মহান শিল্পী ১৯৯০ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক পদক, ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা একাডেমি আজীবন সম্মাননা পদক, ২০০৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে শিল্পকলা একাডেমি পদক এবং ২০০৬ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পেয়েছিলেন। তবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নিজ বাড়ির সামনে আঞ্চলিক গানের এই সম্রাজ্ঞীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হয়। যিনি এত খ্যাতি আর সম্মান অর্জন করেছিলেন তাঁর স্মৃতি বিজড়িত নিজের সমাধিস্থল ছাড়া আর কিছুই নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। গতকাল শনিবার কানুনগোপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সড়কের পাশে তাঁর সমাধিস্থল। সমাধির উপরে শেফালী ঘোষের ভাস্কর্য রয়েছে। ২০০৮ সালের ১৯ জানুয়ারি তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া তাঁর স্মৃতিতে ফলক উন্মোচন করেন।
আমুচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সুব্রত বিশ্বাস সিকিম বলেন, শেফালী ঘোষের স্মৃতি নিয়ে সরকার কিছুই করেনি। আমরা চেয়েছিলাম শেফালী ঘোষের নামে আঞ্চলিক গানের একটি অডিটোরিয়াম হোক বা অন্য কিছু হোক। কিন্তু কিছুই হলো না। শেফালী ঘোষের স্মৃতি ধরে রাখতে একটি আঞ্চলিক গানের প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা প্রয়োজন।
আমুচিয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান কাজল দে বলেন, শেফালী ঘোষের পরিবার যদি জায়গা দিয়ে সহযোগিতা করে তাহলে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর নামে সাংস্কৃতিক অডিটোরিয়াম করার চেষ্টা করব।