ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহের ১৩৫তম তিরোধান দিবসের ৩ দিনের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন

ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহের ১৩৫তম তিরোধান দিবসের ৩ দিনের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন

শুভব্রত আমান/
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত ফকির লালন শাহের মাজার প্রাঙ্গণে তাঁর ১৩৫তম তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়েছে।
আজ (১৭ অক্টোবর) বিকেল পাঁচটায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় এ অনুষ্ঠানের। এবছরই প্রথমবারের মতো এই উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় লেখক, গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এবং কবি, চিন্তক ফরহাদ মজহার।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক রেজা উদ্দিন স্টালিন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মফিদুর রহমান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ. আ. মামুন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার।
প্রধান বক্তা অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেন, “লালন তাঁর চিন্তা ও দর্শনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু সমকালীন ইতিহাসে লালন প্রস্ফুটিত হয়ে দেখা দেয়নি। এর কারণ হলো, ঐ সময়ের কথিত নবজাগরণে লালনের নাম উল্লেখিত হয়নি।”
তিনি বলেন, “ইতিহাসে নাম ওঠেনি মানে লালন কোথাও ছিলেন না—একেবারেই তা নয়। তিনি নদীয়ার অংশবিশেষেই অবস্থান করেছেন। সত্য হলো, লালনকে আবিষ্কার করা হয়নি; লালনের উপস্থিতি দেখানো হয়নি। কিন্তু লালন ছিলেন।”
তিনি আরও বলেন, “চরম বাস্তবতা হলো—উনিশ শতকের কুষ্টিয়া–নদীয়া অঞ্চলে লালনকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক গভীর ভাবান্দোলনের জগৎ, যার কেন্দ্রে ছিল মানবমুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এমন এক শ্রেণির চিন্তাশীল মানুষ, যাঁরা সমাজের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণতা থেকে মানুষকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। লালন ছিলেন এই মানবতাবাদী চেতনার মূল আলোকবর্তিকা।”
তিনি বলেন, “লালন ছিলেন প্রশ্নের কবি, দর্শনের গায়ক। তিনি যে প্রশ্ন উনিশ শতকে তুলেছিলেন, তা একবিংশ শতাব্দীতেও ভয়ডরহীনভাবে তোলার সাহস আজ কজনের আছে? তাঁর গানেই ধ্বনিত হয় অন্তরের দ্রোহ, সামাজিক ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচনের সাহস।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “বহু বছর আগে লালন যে শিক্ষাগুলো দিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়ে যে মানবতাবাদী দর্শন উঠে এসেছিল, তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী।”
তিনি আরও বলেন, “লালন ধামকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও লালনের দর্শন ছড়িয়ে পড়তে পারে। এভাবেই বাংলাদেশের জনগণ নিজেদেরকে উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।”
উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার এই প্রজন্মকে লালনের দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এই তরুণ প্রজন্ম অনেকটা দুঃখী প্রজন্ম; তাদের সঠিক পথটি দেখাতে হবে, যাতে তারা দেশগঠনে অংশ নিতে পারে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফিন।
অনুষ্ঠানে প্রয়াত প্রখ্যাত লালনসংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের স্মরণে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীও আয়োজন করা হয়।
ইতিমধ্যে ছেঁউড়িয়ার লালনধাম ও মাজার প্রাঙ্গণ যেন উৎসবের রঙে রঙিন এক প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। চারদিক জেগে উঠেছে বাউলদের পদধ্বনি, খোল-বাঁশির ছন্দ আর আগত সাধু-ভক্তদের মিলনস্রোতে। রঙিন আলোকসজ্জা, প্যান্ডেল আর দোকানের সারি পুরো এলাকাকে করে তুলেছে আলোকময় ও আনন্দমুখর। আখড়াবাড়ির চারপাশে ভেসে আসছে একতারা-দোতারার মধুর সুর—লালনের গান যেন বাতাসে মিশে গেছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিটি হৃদয়।

Explore More Districts