চি/র/নি/দ্রা/য় শা/য়ি/ত ভাষা সৈনিক কমরেড আহসান উল্লাহ্ চৌধুরী – Chittagong News

চি/র/নি/দ্রা/য় শা/য়ি/ত ভাষা সৈনিক কমরেড আহসান উল্লাহ্ চৌধুরী – Chittagong News

পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে পারি দিয়েছেন দেশের সূর্য সন্তান ভাষা সৈনিক,  প্রবীন রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা কমরেড আহসান উল্লাহ্ চৌধুরী (৮৯)।

(১৭ অক্টোবর) রাত ৯টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ……রাজেউন)। তিনি স্বায়িত্বশীল উন্নয়ন সংগঠন ইপসা’র ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার ড. শামসুন্নাহার চৌধুরীর পিতা ও একই সংস্থার প্রধান নির্বাহী ড. মো. আরিফুর রহমানের শ্বশুর। এছাড়া মৃত্যুকালে তিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।  ১৮ অক্টোবর  (শনিবার) সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম শহরের আফমী প্লাজার পেছনের আবাসিক এলাকায় তাঁর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

এর পর দুপুরে স্বাধীনতার এ সূর্যসন্তানের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নিজগ্রাম মীরসরাইয়ের চৈতন্যের হাটের জনার্দনপুর গ্রামে।

মীরসরাই সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আলাউদ্দিন কাদের রাষ্ট্রের পক্ষে সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় জাতীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত মরহুমের মরদেহে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়।

বাদজোহর পুলিশের একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়। বিউগলে করুন সুর বাজানো হয়। এক মিনিট নীরবতা পালন শেষে একই স্থানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। সমাজের সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁর জানাজায় শরিক হয়।

কমরেড আহসান উল্লাহ্ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ :

 প্রয়াত কমরেড আহসান উল্লাহ্ চৌধুরীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিভিন্ন সংগঠন শোক প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন  প্রেসিডিয়াম সদস‍্য, চট্টগ্রাম জেলা কমিটির প্রাক্তন সভাপতি, বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী’র প্রয়াণে প্রাক্তন জাসদ ফোরারের পক্ষে ডা. মাহফুজুর রহমান, সোলায়মান খান, শ ম নজরুল ইসলাম, নূরুল আরশাদ চৌধুরী, মশিউর রহমান খান এক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করছে।  তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

শ্রমজীবী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা আহসান উল্লাহ্ চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ফেনী থানার বালিগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে পরিবারের সাথে তিনি মীরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের জনার্দনপুর গ্রামে স্থায়ী নিবাসী হন। পিতা বদিউজ্জামান ও মা রফিকুন্নেসা চৌধুরী। মাত্র পাঁচবছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। ফলে বাবার শাসন ছিল না বলেই ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন ডানপিঠে। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু তাদের নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বোর্ড স্কুলে। ১৯৫২ সালে তিনি ফেনীর ফুলগাজী থানার আলী আজম উচ্চবিদ্যালয় থেকে ঢাকা বোর্ডের অধীনে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফেনী কলেজে ভর্তি হন উচ্চমাধ্যমিকে। সেসময় কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি (ইউপিপি) ও ইউনাইটেড স্টুডেন্ট সোসাইটি (ইউএসএস) নামে দুটি ছাত্রসংগঠন ছিল ওই কলেজে। ইউপিপি বাম প্রগতিশীল চিন্তাধারার ও ইউএসএস ছিল দক্ষিণপন্থি পশ্চাদপদ চিন্তাধারার সংগঠন। তিনি ইউপিপির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং কলেজ ছাত্র-সংসদের সহকারী সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। তিনি বিএ পড়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে।

কমরেড আহসান উল্লাহ্ চৌধুরী ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বহির্বিভাগে চাকরি নেন। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং পার্টির নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক-আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হন। তখন পার্টির পক্ষ থেকে শ্রমিক ফ্রন্টে কাজ করতেন দেবেন সিকদার ও চৌধুরী হারুন অর রশিদ। চট্টগ্রামের শ্রমিক আন্দোলনকে জাতীয় স্বাধীকার আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করতে তিনি নিরলস শ্রম ও সাহসী নেতৃত্ব দেন। শ্রমিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে তাঁকে নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয় এবং ১৯৬৫ সালে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। শৈশবে তিনি কৃষকনেত্রী ইলা মিত্র, আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের নেত্রী জামিলা বুপাশাসহ বিভিন্ন সংগ্রামী নেতাদের জীবনী পাঠ করে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে অনুপ্রাণিত হন এবং ৪০ বছরের বেশি সময় ব্যয় করেন সক্রিয় শ্রমিক-রাজনীতিতে। ১৯৬৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে ও আন্দোলনের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতাল ও স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে তিনি অন্যান্য বাম প্রগতিশীল শ্রমিকনেতাদের নিয়ে গঠন করেছিলেন চট্টগ্রাম সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারি সংগ্রাম পরিষদ।

কমরেড আহসান উল্লাহ্ ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারিকে সংঘটিত করে অস্ত্রবোঝাই পাকিস্তানী “সোয়াত” জাহাজকে ঘেরাও করে অস্ত্র খালাসে বাধা সৃষ্টি করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র-যুবকদের সংঘটিত করে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যাওয়া এবং ট্রেনিং শেষে গেরিলাযোদ্ধাদের স্বদেশভূমিতে ফিরিয়ে আনার মতো দুঃসাহসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিপ্লবী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে গঠন করা হয়েছিল “বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র”। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসের বেতন পাওয়ার পর তিনি তা পার্টি ফান্ডে দান করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তাঁর নেতৃত্বে শ্রমিক-কর্মচারিরা বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেন। তিনি অনেক নির্যাতন, জুলুম, হুলিয়া ও নানান বাধার সম্মুখিন হয়েছিলেন, বারবার তাঁকে যেতে হয়েছে আত্মগোপনে। যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা পবাদিপশুসহ ঘরের সকল মালামাল লুঠ করে এবং তাঁদের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয় এবং তাঁর একমাত্র বড়ভাই আনোয়ার উল্লাহ্ চৌধুরীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড আহসান উল্লাহ্

কমরেড আহসান উল্লাহ্ ১৯৬৯ সালে সিপিবি’র চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, ১৯৭২ সালে সহ-সম্পাদক, ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম নগর কমিটির সম্পাদক পরবর্তীতে চট্টগ্রাম নগর ও উত্তর জেলা নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কমিটি হলে তিনি সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৮০ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ১৯৮৬ সালে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি শ্রমিক প্রতিনিধি দলের নেতা ও সদস্য ও সদস্য হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানী, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স ও ভারত সফর করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। তিনি নিয়মিতভাবে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কলাম লিখতেন। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ পরিশ্রমী, সৎ, বিশ্বস্ত, দায়িত্বশীল ও সৃজনশীল মানুষ। কোনো বিত্ত-বৈভব, পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির চিন্তা তার মাথায় কখনো স্থান পায়নি। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে শ্রমিক আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্যে সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী পত্রিকা কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরীকে সম্মাননা স্মারকে ভূষিত করে।

Explore More Districts