চাঁদপুর সদরে দারিদ্র্যতাকে জয় করা শাম্মী হতে চায় আদর্শ শিক্ষক

চাঁদপুর সদরে দারিদ্র্যতাকে জয় করা শাম্মী হতে চায় আদর্শ শিক্ষক

চাঁদপুর সদর উপজেলার প্রত্যন্ত হামানকর্দি গ্রামে জন্ম নেওয়া সুমাইয়া আক্তার শাম্মী আজ হাজারো শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণার নাম। বাবার মৃত্যু, অভাব-অনটন, সংসারের দায়ভার; সবকিছু উপেক্ষা করে টিউশনির আয়েই যে মেয়েটি টিকিয়ে রেখেছে নিজের স্বপ্ন এবং লেখাপড়া, সেই শাম্মী ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে অর্জন করেছেন জিপিএ-৫।

এই অর্জন শুধুই একটি ফলাফল নয়, এ এক সংগ্রামী জীবনের গর্বিত স্বীকৃতি, যা প্রমাণ করে, প্রতিকূলতা কখনোই একাগ্রতা ও পরিশ্রমকে হারাতে পারে না।

মর্মান্তিক শুরুর গল্প:
২০২০ সালের এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান শাম্মীর বাবা, গার্মেন্টসের ফ্লোর ইনচার্জ আমির হোসেন বেপারী। তখন থেকেই শাম্মীর জীবনে শুরু হয় যুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়। পরিবারের একমাত্র পুরুষ অভিভাবক হারিয়ে মা ও দুই বোনের সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। বড় বোনের বিয়ের পর মা রিক্তা বেগম ও শাম্মীকে লড়তে হয় এক নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে।

শাম্মীর স্বপ্ন: ভবিষ্যতে তার মতো লড়াই করে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখা।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই সংসারের হাল ধরেন শাম্মী। শুরু করেন টিউশনি। একে একে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী সংখ্যা, বর্তমানে তিনি ১৫ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান। প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা টানা পড়ানোর পর রাত ৯টা কিংবা তার পরেও শুরু হয় নিজের পড়াশোনা। তার কথায় “আমি কারো বোঝা হতে চাই না। নিজের শ্রম, মেধা ও যোগ্যতায় আত্মনির্ভরশীল হয়ে মাকে সুখে রাখতে চাই।”

সংসার চালিয়ে স্বপ্ন দেখা:
শাম্মীর মাসিক আয় মাত্র ৫-৬ হাজার টাকা। এই সামান্য অর্থেই চলে তার ও মায়ের খাওয়া, লেখাপড়ার খরচ, পরীক্ষার ফিসহ তার সবকিছু। বিলাসিতার কোনো স্থান নেই জীবনে। মা-মেয়ে থাকেন একটি জরাজীর্ণ টিনশেড ঘরে। কিন্তু আছে সাহস, স্বপ্ন, আর অদম্য আত্মবিশ্বাস।

এর আগেও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পাশাপাশি কুমিল্লা বোর্ড থেকে পেয়েছেন মেধাবৃত্তি। এবার এইচএসসিতেও তার মেধার দ্যুতি ছড়িয়েছে সফলভাবে।

মায়ের চোখে গর্ব আর অশ্রু:
শাম্মীর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ও শক্তির উৎস তার মা রিক্তা বেগম। তিনি বলেন, “আমার কল্পনাতেও ছিল না শাম্মী এতদূর যাবে। কিন্তু বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ কষ্টের প্রতিদান দেবেন। বাবার মৃত্যুর পর আমি ওকে সাহস দিয়েছি এবং বলেছি ‘তুমি পারবে।’ আজ সে যা করেছে, ওর বাবা থাকলে কতটা খুশি হতেন! আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, ও যেন তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।”

একইসঙ্গে তিনি সমাজের বিত্তবান ও সরকারকে আহ্বান জানান, শাম্মীর মতো অসংখ্য দরিদ্র অথচ মেধাবী; যেসব শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে।

শিক্ষক

শিক্ষকদের কণ্ঠে গর্বের সুর:
জিলানী চিশতী কলেজের ইংরেজি শিক্ষক মো. জহিরুল ইসলাম খান মুরাদ বলেন, “শাম্মী অত্যন্ত মেধাবী ও আদর্শ শিক্ষার্থী। তার মাঝে একজন আদর্শ শিক্ষার্থীর যতগুণ প্রয়োজন তার মাঝে সব গুণই আছে। ওর এই সংগ্রামী সাফল্য ধরে রাখতে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা প্রয়োজন।”

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. কামরুল হাসান এবং জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রুহুল্লাহ; উভয়েই শাম্মীর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, “শাম্মীর মতো মেধাবী শিক্ষার্থীরা আমাদের সমাজের সম্পদ। তাদের পাশে দাঁড়াতে সমাজের সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসা জরুরি।”

স্বপ্ন এখন শিক্ষক হওয়ার:
এইচএসসির গণ্ডি পেরিয়ে শাম্মীর নতুন লক্ষ্য-ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া। কারণ, তিনি চান ভবিষ্যতে তার মতো লড়াই করে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে।

শাম্মীর কণ্ঠে প্রত্যয়ের উচ্চারণ- “আমি কারও ওপর নির্ভর করে বাঁচতে চাই না। নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে মায়ের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাই।”

গণমাধ্যমে কথা বলার সময় তিনি তার কলেজ, শিক্ষক ও চারপাশের শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুল করেননি।

একজন শাম্মীর গল্প, হাজারো স্বপ্নবাজের প্রেরণা শাম্মীর গল্প এক তরুণীর সংগ্রামের নয়, বরং হাজারো সম্ভাবনার প্রতীক। যেখানে অনেকে সুযোগ পেয়েও পিছিয়ে পড়ে, সেখানে শাম্মীর মতো কেউ কেউ সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, “ইচ্ছা, শ্রম ও মায়ের দোয়া থাকলে কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়।”

আপনি যদি মনে করেন, শাম্মীর পাশে দাঁড়ানো উচিত; তাহলে আপনার ক্ষুদ্র সহায়তাও হতে পারে তার স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি। কারণ, প্রতিটি ‘শাম্মী’-ই আমাদের সমাজের বাতিঘর।

প্রতিবেদক: মুসাদ্দেক আল আকিব/
১৮ অক্টোবর ২০২৫

Explore More Districts