চাঁদপুর শহরে অসুস্থ-আহত কুকুরের করুন চিত্র

চাঁদপুর শহরে অসুস্থ-আহত কুকুরের করুন চিত্র

চাঁদপুর শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্রতিদিন চোখে পড়ে অসুস্থ, ক্ষতবিক্ষত ও চর্মরোগে আক্রান্ত পথকুকুর। দীর্ঘদিন ধরে এদের শরীরে দেওয়া হয়নি কোনো ধরনের ভ্যাকসিন, নেই নিয়মিত চিকিৎসা, নেই কোনো নিবন্ধন বা পুনর্বাসনের উদ্যোগ। অথচ শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিনোদন কেন্দ্র পর্যন্ত কুকুরদের বিচরণ প্রতিনিয়ত। এসব অসহায় প্রাণী শুধু নিজেরাই কষ্ট পাচ্ছে না, বরং জনস্বাস্থ্য এবং শিশুসহ পথচারীদের জন্য তৈরি করছে বড় ধরনের ঝুঁকি।

গত ৫/৬ মাস ধরে শহরের ছায়াবাণী, মিশন রোড, বাসস্ট্যান্ট, চেয়ারম্যান ঘাটা, পাল বাজার, বিপনীবাগ, নতুন বাজার ও পুরান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় শত শত কুকুর, যাদের গলায় দগদগে ক্ষত, শরীরজুড়ে পুঁজ ও রক্তের দাগ। আশেপাশের দোকানদার, পথচারীরা ও পশুপ্রেমীরা কেউ কেউ তাদের পানি বা খাবার দিলেও, তার যন্ত্রণার উপশমে নেই কোনো কার্যকর সহায়তা। এমন অসুস্থ কুকুর শহরের নাজিরপাড়া, পালপাড়া, বটতলা, চিত্রলেখা মোড়, কলেজ রোড, বাসস্ট্যান্ড, সব জায়গাতেই দেখা যায়। অনেকে ইনফেকশনে অন্ধ হয়ে গেছে, অনেক কুকুর চিকিৎসাসেবা না পেয়ে কাতরাতে কাতরাতে সড়কেই মৃত্যুবরণ করেছে। আবার কোন কোন কুকুর অসুস্থ্য শরীর নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলাফেরা করছে। কিন্তু এসব পথ কুকুরদের সেবার জন্য কেউই এগিয়ে আসেনি। চাঁদপুর প্রাণী সম্পদ কার্যালয় এবং চাঁদপুর পৌরসভা কর্তপক্ষের এসব নিরীহ পশুদের প্রতি খেয়াল রাখার কথা থাকলেও তারা যেনো চোখ থেকেও অন্ধ।

শহরের বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে জানা যায়, সর্বশেষ শহরের এসব বেওয়ারিশ পথ কুকুরদের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছিলো প্রায় দুই বছর আগে। এরপর থেকে কোনো ধরনের কুকুর টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হয়নি। র‌্যাবিস, ক্যানাইন ডিস্টেম্পার, পারভোভাইরাসসহ একাধিক ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কুকুরগুলো। অথচ এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ভ্যাকসিন অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন ছাড়া কুকুরদের রোগ সংক্রমণ শুধু তাদের জীবন বিপন্ন করছে না, বরং মানুষের দেহেও পরোক্ষভাবে ছড়াচ্ছে সংক্রমণের আশঙ্কা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষদের জন্য এসব সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে।

প্রাণিকল্যাণ আইন অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে পথকুকুরদের নিবন্ধন, ভ্যাকসিনেশন, চিকিৎসা এবং প্রয়োজন হলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু চাঁদপুর পৌরসভা কিংবা জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে এই দীর্ঘ সময়েও নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকরী উদ্যোগ। পথকুকুর নিয়ন্ত্রণে ধরপাকড় বা নির্মম হত্যার মতো নিষ্ঠুর ব্যবস্থা না থাকলেও, বিকল্প কোনো মানবিক বা পরিকল্পিত ব্যবস্থার ছোঁয়াও নেই।

এসব অবলা বোবা নীরিহ প্রাণীদের রক্ষা করতে হলে দরকার, পৌরসভার মাধ্যমে শহরব্যাপী কুকুর টিকাদান কর্মসূচি চালু করা। ভ্রাম্যমাণ পশু চিকিৎসা ইউনিট চালু করে প্রতিদিন অন্তত একটি এলাকায় চিকিৎসা দেওয়া। একটি কুকুর পুনর্বাসন ও সুরক্ষা কেন্দ্র স্থাপন যেখানে আহত বা অসুস্থ কুকুরদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে আবার রাস্তায় ছেড়ে দেয়া।

সচেতনতা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে জনসাধারণকে কুকুরকে ভয় না পেয়ে সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ শেখানো।

স্থানীয় প্রাণিপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে টাস্কফোর্স গঠন করা।

চাঁদপুর শহরের কিছু যুবক ও প্রাণিপ্রেমী কিছু মানুষ প্রতিদিন কিছু কুকুরকে দোকান থেকে কেক কিনে খাবার দেয়ার পাশাপাশি নিজেদের অর্থ খরচ করে ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগান, এমনকি ওষুধ কিনে প্রাণীদের চিকিৎসা করান। কিন্তু এতটুকু চেষ্টায় সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাদের দাবি, পৌরসভা যদি অন্তত একটি অস্থায়ী পশু চিকিৎসাকেন্দ্র চালু করে, তাহলে আমরা স্বেচ্ছাশ্রম দিতে রাজি আছি। তবে একটি গঠনমূলক উদ্যোগ প্রয়োজন।

চাঁদপুর শহরের ব্যস্ততম এলাকা বাসস্ট্যান্ড, মিশন রোড, ছায়াবাণীসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই অসুস্থ কুকুরদের দেখা যায়। কিছু কুকুরের মুখে ফেনা দেখা গেছে যা র‌্যাবিসের লক্ষণ হতে পারে।

নাজিরপাড়া ও পালপাড়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, কুকুরদের লড়াইয়ের শব্দে রাতে ঘুম ভেঙে যায়, অনেক কুকুর অসুস্থ হয়ে খাবার না পেয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে থাকে।

মিশন রোড, বাসস্ট্যান্ট, ছায়াবাণী, চিত্রলেখা মোড় এলাকায় কিছু কুকুর চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষত হয়ে শরীরের বড় অংশে লোম উঠে গেছে।
বটতলা, কলেজ রোড ও হাসান আলী স্কুল মোড় এখানে অসুস্থ কুকুরগুলো স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পিছু নেয়, কখনো কখনো কামড়ানোর ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক অভিভাবকরা।

চাঁদপুর শহরের প্রতিটি অলিগলিতে রাস্তা-ঘাটে এই অবহেলিত প্রাণীগুলোর আর্তনাদ প্রতিদিন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেই কান্না শুনছে না কেউ। জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থেই এখন সময় এসেছে একটি সমন্বিত, মানবিক এবং টেকসই উদ্যোগ গ্রহণের। না হলে অসংখ্য নিরীহ প্রাণীর মৃত্যু ও মানবিক দুর্যোগ ঘটতেই থাকবে।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ জকিরময় ভৌমিক জানান, এসব বেওয়ারিশ কুকুরকে সেবা দেয়া আমাদের কাজ নয়। পথকুকুরদের দেখা শুনার দায়িত্ব হচ্ছে লোকাল জনস্বার্থের কাজ। যেমন পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব। তবে কেউ যদি পশু পালন করে, কিংবা আদর করে আমাদের কাছে নিয়ে আসে আমরা তাদেরকে সেবা প্রদান করি।

এবিষয়ে চাঁদপুর পৌরসভার প্রশাসক মোঃ গোলাম জাকারিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে সম্প্রতি আমরা পৌরসভার পক্ষ থেকে চাঁদপুর সরকারি হাসপাতালে ৩ লাখ টাকার জলাতঙ্কের টিকা প্রদান করেছি। তারপরেও আমি যেহেতু শুনেছি, অসুস্থ কুকুরকে সেবা দেওয়া এবং ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্তৃপক্ষের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।

প্রতিবেদক: কবির হোসেন মিজি, ৯ জুলাই ২০২৫

Explore More Districts