চরফ্যাশনের ২০ চর:সুপেয় পানির হাহাকার, আছে নিরাপত্তা শঙ্কাও

চরফ্যাশনের ২০ চর:সুপেয় পানির হাহাকার, আছে নিরাপত্তা শঙ্কাও

১৮ September ২০২৫ Thursday ১১:৫৭:০৫ AM

Print this E-mail this


চরফ্যাশন ((ভোলা) প্রতিনিধি:

চরফ্যাশনের ২০ চর:সুপেয় পানির হাহাকার, আছে নিরাপত্তা শঙ্কাও

ভোলার চরফ্যাশনের নদীঘেরা ২০টি দুর্গম চরে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের বসতি। অন্ন ও বস্ত্রের ক্ষীণ চাহিদা কোনোভাবে পূরণ হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিশুদ্ধ পানির মতো সেবাগুলো থেকে এখনো তারা বঞ্চিত। একদিকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অন্যদিকে ভূমিদস্যু, জলদস্যু আর ঠগ-বাটপারের কবলে পড়ে প্রতিনিয়তই এরা সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে নালিশ-বিচার দিয়েও চরের মানুষ অধিকারবঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। চরফ্যাশনের চরবাসী আজও রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারার বাইরে পড়ে আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের আলো চরাঞ্চলের ঘরে ঘরে পৌঁছেনি। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানবসৃষ্ট বিপদ : প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এই চরবাসীরা। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, জোয়ার সব সময়ের আতঙ্ক। ভূমিদস্যু, জলদস্যু আর প্রতারকদের দৌরাত্ম্য চরবাসীর জীবনে নতুন দুর্ভোগ যোগ করেছে। চরগুলোর অনেকাংশে নেই কোনো বাঁধ, নেই সাইক্লোন শেল্টার। চলতি বছরের পুরো বর্ষাজুড়ে হওয়া উচ্চ জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস আর ঝড়ের ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি মানুষ। ঢালচর, সিকদারের চর, চরমোতাহার, চরমন্তাজ, চরপাতিলা, চরফারুকি, চরশাহাজালাল, চররিরউলিন, সিকদারচর, টুংচর, চরমনোহর, চরলিউলিন, চর স্টিফেন, চরবাংলা, চরমোনতাজসহ বহু চর এখনো রয়ে গেছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়।

শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা : চরবাসীর সবচেয়ে করুণ চিত্র ফুটে ওঠে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায়। ঢালচরের শিশুদের জন্য স্কুলে যাওয়া মানেই নদী, খাল আর কাদার বাধা পেরিয়ে এক যুদ্ধযাত্রা। অনেকেই সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আজ শিশুশ্রমিক, কেউ বা জেলে পরিবারের সহায়ক হিসাবে নেমে পড়েছে মাছ ধরার কাজে। পশ্চিম ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে দোতলায় চলে শিক্ষা কার্যক্রম। নেই পর্যাপ্ত আসন, খেলার মাঠ, টয়লেট। শিক্ষার্থী সংখ্যা এক সময় ছিল ৩৫০। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭০ জনে। ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. আমীর হোসেন বলেন, ভাঙনের মুখে থাকায় শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন দিন কমছে। দাখিল মাদ্রাসার পাশেই রয়েছে একতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন। পুরনো ভবনটির পলেস্তারা খসে পড়ছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ইয়াসমিন বলেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের মাদ্রাসায় ক্লাস চালু করার মতো কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবকিছু ভেঙে ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কবে আবার ক্লাসে যেতে পারব জানি না। ঢালচরের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হাওলাদার বলেন, এই দ্বীপের অভিভাবকরা অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। কিন্তু প্রকৃতির বৈরিতায়, বিশেষ করে নদীভাঙনের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় মারাত্মক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বর্ষাকালে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে খুবই সমস্যা হয়। 

যোগাযোগব্যবস্থা : পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ, চরের অবকাঠামো এতই দুর্বল যে, বর্ষায় হাঁটতে গেলেও হাঁটুসমান পানি ডিঙিয়ে চলতে হয়। সিকদারচরে নেই কোনো পাকা রাস্তা কিংবা সেতু। কাঁচা সড়কের অবস্থাও শোচনীয়। চরের বাসিন্দারা বলছেন, এখানকার সব সমস্যার মূলে বেহাল যোগাযোগব্যবস্থা। উপযুক্ত সড়ক না থাকার কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ সবখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছেন ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দা। 

বিশুদ্ধ পানির জন্য লড়াই : চরের সবচেয়ে বড় সংকট বিশুদ্ধ পানির অভাব। নদী ও সাগরের মাঝে বসবাস করলেও পান করার জন্য নেই নিরাপদ পানির উৎস। অধিকাংশ জায়গায় গভীর নলকূপ নেই। যেগুলো আছে তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। জেলেরা জানিয়েছেন, মাছ ধরার জন্য যখন সাগরে যান, তখন নদীর নোংরা বা কাদামাখা পানিই তাদের একমাত্র ভরসা। উপজেলার চরফকিরার বাসিন্দা মালেক মাঝি সুপেয় পানির জন্য আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাগো এইহানে খাওয়ার পানির (সুপেয়) অভাব। কল বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে। পানির তৃষ্ণা ধরলে যেখানে পানি পাই সেখান থেকেই খাই। ঢালচর ইউনিয়নের সদ্য সাবেক ইউপি সচিব নান্নু পাটোয়ারি বলেন, এই চরে প্রায় ১২ হাজার মানুষের বাস। গভীর নলকূপ ছাড়া নিরাপদ পানি পাওয়া যায় না। বঙ্গোপসাগর মোহনাসংলগ্ন হওয়ায় প্রায়ই তলিয়ে যায় ঢালচর। এ সময় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। 

স্বাস্থ্যসেবা : চর এলাকায় পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। এখানকার অধিকাংশ মানুষ জীবনে একবারও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মুখ দেখেননি। নেই কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক। সাধারণ জ্বর, ব্যথা বা অন্যান্য রোগের জন্য তারা এখনো ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভর করেন। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানি জমে থাকায় চর্মরোগ, অ্যালার্জি, জ্বর, পাতলা পায়খানা ও আমাশয় লেগে থাকে। 

ভূমিদস্যু ও জলদস্যুর আতঙ্ক : জেলেদের জন্য বর্ষার ইলিশ মৌসুম রোজগারের সময়। কিন্তু এ সময়ে থাকে জলদস্যুর আতঙ্ক। জলদস্যুরা নদীতে জেলেদের ওপর হামলা করে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে আশ্রয় নেয় ওইসব চরে। পরে পুলিশি ঝামেলা পোহাতে হয় চরবাসীকে। চরের মানুষের আরেক আতঙ্ক ভূমিদস্যু। ধানের মৌসুমে ভূমিদস্যুরা লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে চরে অবস্থান নেয়। সাধারণ কৃষকদের ধান কেটে নিয়ে যায়। 

চরবাসীর আকুতি-উন্নয়নের ছোঁয়া চাই : ঢালচরের সাবেক ইউপি সচিব নান্নু পাটোয়ারি বলেন, এই চরের মানুষের চলাচলের জন্য পুল-কালভার্ট, রাস্তা আর টিউবওয়েল অতিপ্রয়োজন। নদীভাঙন প্রতিরোধ করা না গেলে এসব চরের অস্তিত্বই থাকবে না। চরাঞ্চলকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলারও যথেষ্ট সুযোগ আছে।

চরমনোহর, চরলিউলিন, চরমোতাহার দুই বছর ধরে নদীভাঙনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এভাবে ভাঙতে থাকলে আগামী তিন বছরে ৩টি চর চরফ্যাশনের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙন রোধে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। ভোলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম মাহমুদুর রহমান জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিটি ইউনিয়নে ১২টি করে গভীর নলকূপ স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর ফলে চরাঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট অনেকাংশে দূর হবে।

সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক


শেয়ার করতে ক্লিক করুন:

Explore More Districts