খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর সমৃদ্ধ এক সংগ্রহ ভান্ডার

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর সমৃদ্ধ এক সংগ্রহ ভান্ডার

গাজী মনিরুজ্জামান ঃ খুলনা মহানগরীর শিববাড়ি মোড় সংলগ্ন বিভাগীয় জাদুঘর। প্রসস্থ সিড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার পথেই চোখ আটকে যাবে থরে থরে সাজানো মহান মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য দূর্লভ ছবি দেখে। বিশেষভাবে তৈরী অষ্টভুজাকৃতি জাদুঘর ভবনের ভিতরে আছে ৬টি প্রদর্শণী গ্যালারী, যা ৬টি উইং আকারে রয়েছে। ভেতরের এক থেকে ছয় নম্বর গ্যালারী পর্যন্ত রাখা হাজার বছরের পুরাতন নিদর্শন। দেখতে দেখতে যে কোন দর্শকের পায়ে খিল লেগে যাবে। বিগত দুই যুগে প্রতিষ্ঠানটি খুলনাবাসীর বিনোদন ও জ্ঞান অর্জনের জন্য বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষ করে এটি পরিণত হয়েছে একটি সমৃদ্ধ তথ্য ও সংগ্রহ ভান্ডারে।
জাদুঘরের সহকারী পরিচালক মোঃ গোলাম ফেরদৌস জানান, খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরটি এক একর জমির উপর অবস্থিত। ১৯৯৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার কোটি ৯৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত জাদুঘর ভবনটি উদ্বোধন করেন। আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাদুঘর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে রয়েছে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালকের দপ্তর। এছাড়া এখানে দুইশ’ আসন বিশিষ্ট সুন্দর একটি সেমিনার কক্ষও রয়েছে।
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে থাকা এ জাদুঘরে উপস্থাপিত রয়েছে গুপ্ত, পাল, সেন, মোঘল ও ব্রিটিশ আমলের নানা ধরনের পুরাকীর্তির নিদর্শন, পোড়ামাটি, কস্টি পাথর ও কালো পাথরের মূর্তি, মোঘল আমলের স্বর্ণ ও রূপার মুদ্রা, তামা, লোহা, পিতল, মাটি ও কাচের তৈজসপত্র, বিভিন্ন ধাতুর তৈরী খেলনা, অস্ত্র ও ব্যবহার সামগ্রী, ক্যালিগ্রাফি।
জাদুঘরের প্রদর্শনীর সূচনা হয়েছে ১নং গ্যালারী থেকে। এই গ্যালারীতে স্থান পেয়েছে খুলনার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রতœসম্পদ। এর মধ্যে যশোরের ভরত ভায়না বৌদ্ধ মন্দির, পীরপুকুর মসজিদ, গলাকাটা মসজিদ, জোড়বাংলা মসজিদ, সাতগাছিয়া মসজিদ, জাহাজঘাটা, দমদম পীরস্থান ঢিবি, বাগেরহাটের খানজাহান আলী (রঃ) এর বসতভিটায় প্রতœতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত নিদর্শন। এছাড়া রয়েছে খুলনা আর্ট কলেজ থেকে প্রাপ্ত ১২-১৩ শতকের শক্তি মূর্তি, বাগেরহাটের কচুয়া থেকে প্রাপ্ত মারিচী মূর্তি, খুলনার কপিলমুনি ঢিবি গুচ্ছ থেকে সংগৃহীত পোড়ামাটির সামগ্রী, গুপ্ত যুগের মুদ্রা, খুলনা বিভাগের প্রশাসনিক মানচিত্র ইত্যাদি।
২নং গ্যালারীতে প্রদর্শিত হচ্ছে পোড়ামাটি ও শামুকের তৈরী চুড়ি, লোহার শাবল, পেরেক ও কব্জা, পশুর হাঁড় ও দাঁত। আদি মধ্যযুগীয় প্রতœস্থান যশোরের ভরত ভায়না থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, পোড়ামাটির খেলনা, ওজন, পিরিচ ও থালা ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে খ্রিষ্টীয় ১০ম-১১শ শতকের গণেশ, বিষ্ণু, গরুড়, নন্দীসহ বিভিন্ন ধরনের প্রস্তর নির্মিত মূর্তি।
৩নং গ্যালারীতে দেখানো হচ্ছে উত্তরবঙ্গের প্রতœস্থান মহাস্থানগড় ও মঙ্গলকাটি থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রতœনিদর্শন। এর মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকচিত্র, তামার তৈরী মৃৎপাত্র, স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুতি, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, ছাপাংকিত রৌপ্যমুদ্রা ও ছাঁচে ঢালা মুদ্রা, মসৃণ কালো মৃৎপাত্র এবং পোড়ামাটির ফলকে চিত্রিত মানুষের মাথা প্রভৃতি। আরও রয়েছে খ্রিষ্টীয় ১১শ-১২শ শতকের মহিষমর্দিনী দূর্গা, নন্দী ও ১০ম শতকের নকশাসহ প্যানেলের অংশ বিশেষ ইত্যাদি।
৪নং গ্যালারীতে প্রদর্শিত হয়েছে লালমাই ময়নামতি অঞ্চলে অবস্থিত শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ভোজ বিহার, রাণীরবাংলো, ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, কুটিলা মুড়া ও চারপত্র মুড়া প্রতœস্থান থেকে সংগৃহীত প্রতœসম্পদ। এরমধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকচিত্র, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, ছাপাংকৃত মুদ্রা ও ছাঁচে ঢালা মুদ্রা, নব্য পাথর যুগের জীবাশ্ম কাঠের দ্বারা নির্মিত অস্ত্র প্রভৃতি। ৯ম-১০ম শতকের শাক্যমণি, কালো পাথরের শিল ও নোড়া যা ১০ম শতকের বলে অনুমান। রয়েছে মৌর্য, গুপ্ত, সুলতানী ও মোঘল যুগের বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা এবং ১২শ-১৫শ শতকের কালো পাথরের উপর খোদিত আরবী ও ফারসী উৎকীর্ণ লিপি।
৫নং গ্যালারীতে শোভা পাচ্ছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের প্রতœনিদর্শন। পাহাড়পুর বৌদ্ধমন্দির থেকে সংগৃহীত জীব-জন্তু, গাছ-পালার ছবি অংকিত বিভিন্ন ধরনের মানব প্রতিকৃতি পোড়ামাটির ফলক।
আর ৬ নং গ্যালারীতে প্রদর্শিত হচ্ছে গৌড়, লালবাগ কেল্লা, সাভার ও রোয়াইল বাড়ী থেকে সংগৃহীত প্রতœবস্তু। যার মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির নকশাকৃত ইট, শিলালিপি, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, ছাপাংকৃত মুদ্রা ও ছাঁচে ঢালা মুদ্রা, চকচকে রঙ্গিন প্রলেপযুক্ত টাইল্স প্রভৃতি। খ্রিষ্টীয় ১৭শ-১৯শ শতকের আরবী ও ফারসী হস্তাক্ষর লিপি, একশত বছরের পুরানো কাঠের খাট ইত্যাদি। ১৮শ-১৯শ শতকের বিভিন্ন ধাতব ধরন ও পাথরের তৈরী তৈজসপত্র প্রভৃতি।
অফিস তত্বাবধায়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিজয় কুমার ঘোষ জানান, জাদুঘর গ্রীষ্মকালে ০১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ১:৩০ পর্যন্ত আধ ঘন্টার জন্য বন্ধ থাকে। আর শীতকালে ০১ অক্টোবর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১:৩০ পর্যন্ত আধ ঘন্টার জন্য বন্ধ থাকে। আর শুক্রবার নামাজের বিরতি ছাড়া বাকী সময় খোলা থাকে। রবিবার পূর্ণদিন সাপ্তাহিক ছুটি। সোমবার অর্ধদিবস অর্থাৎ দুপুর ২টার পর খোলা থাকে। এছাড়া অন্যান্য সরকারী ছুটির দিন জাদুঘর বন্ধ থাকে।
বিজয় কুমার ঘোষ আরো জানান, জাদুঘরের গেটের পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য প্রবেশ মূল্য ২০টাকা। শিশু ও ছাত্র-ছাত্রী ৫ম থেকে ১১শ শ্রেণি টিকেটের মূল্য ১০টাকা। এছাড়া সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীর জন্য প্রবেশ মূল্য ১০০টাকা ও বিশে^র অন্য সব দেশের দর্শনার্থীর জন্য টিকেটের মূল্য ৩০০টাকা।
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, দর্শনার্থী বৃদ্ধির জন্য বিনামূল্যে প্রচারপত্র বিলি করা ছাড়াও অনলাইনে ফেসবুক পাতা খোলা হয়েছে। যেখানে খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরের বিভিন্ন তথ্য ও ছবি নিয়মিত আপলোড করা হয় যাতে নবীন, প্রবীন, তরুণ তরুণীসহ স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা জাদুঘর পরিদর্শনে আগ্রহী হয়।

Explore More Districts