কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৬টি খুনের ঘটনায় জেলাজুড়ে তোলপাড় চলছে। এখানকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে খুন-গুমের হাওয়ায়। এসব হত্যাকাণ্ডের গল্প দীর্ঘ আর বহুমুখী। এদের মধ্যে খুন হওয়ার আগের রাতে নিজের নিরাপত্তায় কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে দৌলতপুর থানায় একটি মামলা করেন উপজেলার শাহাপুর এলাকার জাকির মোল্লা। এই মামলার ৮ ঘণ্টা পর তাকে হত্যা করা হয়।
মঙ্গলবার (২ মে) সকালে উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের শাহাপুর এলাকায় প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন জাকির মোল্লা (৪৭)। তিনি ওই গ্রামের আরব মোল্লার ছেলে। জাকিরের নামে দৌলতপুর থানায় চুরি, মাদক, মারামারিসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৩টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। জাকির হত্যাকাণ্ডের পরদিন বুধবার ১৬ জনের পরিচয় প্রকাশ ও অন্তত ৭ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়। নিহত জাকিরের ছেলে তারিকুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এতে আনোয়ারা খাতুন (৫৫) নামে এজাহারভুক্ত এক নারী আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি মামলার প্রধান আসামি আবু মণ্ডলের স্ত্রী।
জাকির মোল্লা হত্যাকাণ্ডের রহস্য হিসাবে শুরুতেই সামনে আসে খুন হওয়ার আগের রাতে দৌলতপুর থানায় নিজের দায়ের করা মামলাটি। ওই মামলায় ১২ জনের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২০-২৫ ব্যক্তির নামে ক্ষয়ক্ষতি এবং হত্যা চেষ্টার বিষয়টি উল্লেখ করে নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করেন জাকির। এর পরের দিন সকালেই নিজ এলাকায় প্রতিপক্ষের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন তিনি।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৩ মামলার আসামি জাকির মোল্লার বিরুদ্ধে একই এলাকার আবু মণ্ডল নামে এক ব্যক্তির কৃষিজমির কিছু অংশ দখল করে রাখার অভিযোগ ছিল। আবু মণ্ডল অনেক চেষ্টা করেও ওই জমি দখলমুক্ত করতে পারেননি। এবার ওই জমিতে মরিচ চাষ করেছেন জাকির মোল্লা। জমি নিয়ে এই বিরোধের জেরে ঘটনার দিন সকালে জাকির মোল্লার সঙ্গে আবু মণ্ডলের তুমুল বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে জাকিরের বিক্ষুব্ধ স্বজনরা প্রতিপক্ষের কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
পরিবারের অভিযোগে বলা হয়, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে থানায় মামলা করার কারণে জাকিরকে দলবদ্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে খুন হওয়ার আগে জাকির মোল্লার দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি বিল্লাল হোসেনকে নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন হোগলবাড়িয়ার সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি বিল্লাল হোসেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না পুলিশও। তবে অনেকে ধারণা করছেন, তিনি সাবেক চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেনই।
এদিকে জাকির হত্যার মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, স্থানীয় শ্রমিকলীগ নেতা মাহী বিশ্বাস ও তার ভাই সৈয়ব বিশ্বাস। আগের রাতে তারা সৈয়ব বিশ্বাসের জন্মদিন উদযাপনের নামে গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান করেন। সেখান থেকেই হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
হোগলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সেলিম চৌধুরী বলেন, ভণ্ডপীর তাছেরের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল জাকির। এ কারণে তাছেরের লোকজন জাকিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছিল। ঘটনার আগের রাতে এলাকার মাহী বিশ্বাস ও তার ভাই সৈয়ব বিশ্বাস তাদের লোকজন নিয়ে কেক কাটার নাম করে একত্রিত হয়, তারা নতুন করে ষড়যন্ত্র করে। পরের দিন মঙ্গলবার সকালে জাকিরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মজিবুর রহমান জানান, প্রতিটি হত্যার ঘটনা গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সুতরাং প্রকৃত অপরাধীদেরই আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধী যত ক্ষমতাধরই হোক ছাড় দেয়া হবে না। এসব মামলার অভিযুক্ত আসামিরা সবাই আত্মগোপন করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারে অব্যাহতভাবে অভিযান চলছে। শনিবার (৬ মে) পর্যন্ত মোট ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যার শিকার হওয়ার আগে জাকির মোল্লার করা মামলার এক নম্বর আসামি বিল্লাল হোসেন আর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান স্থানীয় বিএনপি নেতা বিল্লাল হোসেন একই ব্যক্তি কিনা তা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি ওসি। তিনি বলেন, এজাহারে প্রধান আসামির বাবার নাম অজ্ঞাত হিসাবে উল্লেখ করায় বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তদন্তকাজ চলছে। তদন্তের পর প্রধান আসামির সঠিক পরিচয় সম্পর্কে জানা যাবে।
উল্লেখ্য, জাকির হত্যার ঘটনাসহ এক সপ্তাহের ব্যবধানে দৌলতপুর উপজেলায় ৬টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চিলমারী ইউনিয়নে রাস্তার জমি নিয়ে বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা, বাড়িঘরে প্রতিপক্ষের দেয়া আগুনে বাবা-ছেলেসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন, চিলমারী গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আকতার মণ্ডল (৪০) একই গ্রামের মৃত দবির মণ্ডলের ছেলে দিনু মণ্ডল (৬৫) ও তার ছেলে ফারুক মণ্ডল (২৫)। তারা রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের মরদেহ নিয়ে আসামিদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। অপরদিকে নিখোঁজের সপ্তাহখানিক পর পদ্মার চরে বালুর নিচে পুঁতে রাখা মারুফ হোসেন (৩৫) নামে এক যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের কোপে নিহত হন নুরুস সালাম (৩০) নামে এক প্রতিবন্ধী যুবক। কয়েকদিনের ব্যবধানে এসব হত্যার ঘটনায় উপজেলাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এনজে