আমারে দিব না ভুলিতে

আমারে দিব না ভুলিতে

স্টাফ রিপোর্টার
‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ মহৎ এই বাণী যিনি অবলীলায় দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, তিনিই কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় এক যুগ ¯্রষ্টা। একদিকে ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, অন্যদিকে শ্যামা সঙ্গীত লিখে তিনি বাঙালি মানসের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরও সুগভীর করেন। সাম্যবাদী, দ্রোহী, অথচ হৃদয়ে রোমান্টিক; এমন সম্মিলিত ভাবধারার বিরল প্রতিভা বাংলা কবিতায় আর দেখা যায় না। মানবতার প্রতি তীব্র দরদি এমন কবি খুঁজে মেলাও ভার। মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহীয়ান’ উচ্চারণকারী কাজী নজরুল ইসলাম আজীবন অন্তরে ধারণ করেছেন ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কা’বা নাই।’ আবার তার কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’। আজ ১২ ভাদ্র; প্রেম ও বিদ্রোহের অমর কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৬তম প্রয়াণ দিবস। এদিনে শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
ধূমকেতুর মতো বাংলা সাহিত্যাকাশে নজরুলের আবির্ভাব হয়েছিল। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন,
‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলকরেখা
রাতের ভালে হোক্ না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে’
আছে যারা অর্ধচেতন।’
রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি ও বিদ্রোহ। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন-শোষণ থেকে উপমহাদেশের মানুষের মুক্তির আন্দোলনে, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের কবিতা ও গান ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। ধর্মীয় বৈষম্য ও কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রবল উচ্চকিত। শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের আর্তি বিশেষভাবে প্রকাশ পায় তার রচনায়। বাংলা শিশুসাহিত্যেও তার অবদান অপরিসীম। শিশুদের মনের কথা বুঝতে পারতেন তিনি। কচি-কাঁচাদের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতেন। তিনি নারীকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন ও সমাজ সভ্যতার অন্যতম নির্মাণকারিণী বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। বলেছেন- ‘জ্ঞানের লক্ষ¥ী, গানের লক্ষ¥ী, শস্য লক্ষ¥ী নারী/সুষমা- লক্ষ¥ী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি।’ নজরুলের সমসাময়িক মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরা নিজেদের সুনির্দিষ্ট গ-ির বাইরে যেতে সক্ষম হননি। অথচ কাজী নজরুল তার শক্তিশালী লেখনীর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্ব চরাচরে। কোনো গ-ির মধ্যে তার সৃজনশীল প্রতিভা সীমিত থাকেনি।
তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। অসংখ্য বৈচিত্র্যময় রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি গায়কও ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, ও অভিনেতা। সাংবাদিকতা করেছেন। দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে কবিতাই তাকে অমর করেছে। দিয়েছে বিদ্রোহীর পরিচয়। ১৯৪২ সালে বিদ্রোহী কবি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারান। থেমে যায় তার কলমও। ১৯৭২ সালের ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মানে সম্মানিত করেন। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দেওয়া হয় একুশে পদক।
নিম্নমধ্যবিত্ত অভাবের সংসারে বেড়ে উঠা নজরুল মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও আপস করেননি; বরং দারিদ্র্য তাকে করেছে মহান, দিয়েছে খ্রিস্টের সম্মান। অর্থ-বিত্তকে ‘পায়ের ভৃত্য’ করে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন ‘আধমরা’ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য। কবিতার বাণীতে তাদের ঘা মেরে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। কবিতার খাতার মতো জীবনজুড়েই ছিল সংগ্রাম। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে।
প্রথম মহাযুদ্ধে ১৯১৭ সালে নজরুল ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯২০ সালের মার্চ অবধি যুদ্ধের ময়দানে সক্রিয় ছিলেন। ১৯২১ সালের নভেম্বরে তিনি মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। ১৯২১ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর অমর দুই সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙ্গার গান’ কবিতা। পরের বছর প্রকাশ হয় কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’। বাংলা সাহিত্যের পথ বদলে দিলেও নজরুল পড়েন রাজরোষে। কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁকে। ১৯২২ সালের শেষদিকে কারাবন্দি হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রক্রিয়া থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তবে পর ১৯২৬ সালে মুজফ্ফর আহ্মদের অনুরোধে তিনি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগীতের অনুবাদ (জাগো অনশন-বন্দি) করেন, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
তিনি ছিলেন চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ ১৯৪১ সালে এক সাহিত্য সভায় নজরুল বলেছিলেন- ‘যদি আর বাঁশি না বাজে-আমি কবি বলে বলছি না-আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি-আমায় ক্ষমা করবেন-আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ তিনি লিখেছেন- ‘আমি চির তরে চলে যাব/তবু আমারে দিব না ভুলিতে’।

Explore More Districts