মো: আনিছুর রহমান, বেনাপোল :একটানা দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের শাসন আমলে শার্শা ও বেনাপোলে ১৬০ জন নেতা কর্মী হত্যার শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং এলাকায আধিপত্য ব্স্তিার ও চোরাচালানী ঘাট নিয়ে দ্বন্দে এসব হত্যা কান্ড সংঘটিত হয় এদের মধ্যে জামাল নামে একজন সাংবাদিক ও এসময়ের মধ্যে নিহত হয়।
নির্মম নিষ্ঠুর এ হত্যকান্ডের মধ্যে এলাকার জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও কমীরা ছিলেন। শার্শা উপজেলার শার্শা সদর থানার ৭৩ টি এবং বেনাপোল পোর্ট থানার ৮৭ টি মামলা হয়। আর এসব মামলায় প্রায় ৩০০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র ও দেয় পুলিশ। আইনের ফাকফোকরে এসব আসামিদের অধিকাংশ নেতা কর্মী জামিনে রয়েছে। আর এসব হত্যা কান্ডের মধ্যে কিছু হত্যাকান্ডের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে এই আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন বলে
এদিকে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা এবং বিচার না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন স্বজনেরা। খুনিরা জামিনে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানোয় স্থানীয়দের মধ্যে বিরাজ করছে ােভ। তবে পুলিশ বলছে, অপরাধীদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে। এ ছাড়া সহিংসতা এড়াতে তারা মানুষকে সচেতন করছে।
তথ্য বলছে, শার্শা উপজেলাতে হত্যার শিকার ১৬০ জনের মধ্যে ৭৭ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, বিএনপির ২৬ জন এবং একজন সাংবাদিক। এ ছাড়া মাদক কারবার, পারিবারিক কলহসহ বিভিন্ন অপরাধে ৫৬ নারী, পুরুষ ও শিশু প্রতিপরে হাতে খুন হয়।
জানা যায়, যশোর শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত শার্শা উপজেলা। এ অঞ্চলে দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দরটি গড়ে ওঠায় বন্দরের নিরাপত্তাজনিত কারণে শার্শা থানার পাশাপাশি ২০০১ সালে বেনাপোল পোর্ট থানা নামে আরেকটি থানা গড়ে ওঠে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মতায় আসার পর বন্দর, ঘাট, বাঁওড় ও গরু খাটাল দখল নিয়ে প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্বে বেশি হত্যার শিকার হয় দলটির নেতা-কর্মীরা। প্রতিশোধ ও আক্রোশমূলক হত্যা করা হয় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে। এ ছাড়া পারিবারিক কলহ ও মাদক কারবার নিয়ে বিরোধেও ঘটেছে হত্যাকাণ্ড।
শার্শা উপজেলার বেনাপোল পোর্ট থানার পুটখালি ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, পুটখালীর আর এক চেয়ারম্যান নূরুদ্দিন ও বেনাপোল ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল করিমকে খুন করে দুর্বৃত্তরা।
শার্শার সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাবু, কায়বার চেয়ারম্যান নূর ইসলাম, বাহাদুরপুরের চেয়ারম্যান বজলুর রহমান ও উলাশীর চেয়ারম্যান জিন্নাত উল্লাহকে খুন করে দুর্বৃত্তরা। ২০০৯ বাগআচড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ওরয়ে বাবুকে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় ইলিয়াস কবির বকুলকে। সংসদ শেখ আফিল উদ্দিন ২০১১ সালে বকুলকে সমর্থন দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে। অপরদিকে বেনাপোল এর পুটখালী ইউপি চেয়ারম্যান রাজ্জাককে হত্যার পর ওই ইউনিয়ন এর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক করা হয় সিরাজুল ইসলামকে। কারন সিরাজ এমপি আফিল উদ্দিন এর অনুসারী ছিল। বেনাপোল পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের কর্মী আব্দুস সামাদকে হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ভুক্ত আসামি সন্ত্রাসী আমিরুল ইসলামকে ২০১৭ সালের কাগজপুকুর বাজার কমিটির সাধারন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হতে সংসদ সদস্য আফিল উদ্দিন সহায়তা করেন। পরে সন্ত্রাসী আমিরুল নিজের বোমায় নিজে নিহত হয়।
এসব চেয়ারম্যান এর মধ্যে হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষ মদদ দাতা হিসাবে গুঞ্জন রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন ।
ভারত সীমান্তবর্তী শার্শার কনেদাহ আতঙ্কের একটি গ্রাম। শুধু বিএনপি করার অপরাধে আক্রোশমূলক গত ১৫ বছরে গ্রামের একই পরিবারের চার বিএনপি নেতা-কর্মী খুন হন। সর্বশেষ খুন হন বিএনপির কর্মী মুকুল। এর আগে বেনাপোলে হত্যা করা হয় তাঁর বাবা বিএনপির কর্মী আব্দুল আজিজকে। পরে আজিজের চাচা নূর ইসলাম, ভাই মুজাম গাজী হত্যার শিকার হন।
হত্যার শিকার কনেদাহ গ্রামের নুর ইসলাম গাইনের ছেলে রোকনুজ্জামান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে বিচার পাইনি। বর্তমান সরকারের কাছে বিচার চাই।’
২০১৫ সালে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে হত্যা করে পুটখালী ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সেক্রেটারি আব্দুল খালেককে। এ ঘটনায় করা মামলার সব আসামি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। খালেকের ছেলে লিটন অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে ন্যায়বিচার চান।
২০২২ সালের ১০ মে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে খুন হন আওয়ামী লীগ নেতা মগর আলী; তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হয় নাতি ইয়াসিন। আসামি গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে এসে মহড়া দেন ভুক্তভোগীদের বাড়ির সামনে। হত্যাকারীদের দাপটে এখন এলাকাছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারের অনেকে।
মগর আলীর ছেলে হাসান বলেন, ‘আসামি গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে এসে মহড়া দেয় বাড়ির সামনে। হত্যাকারীদের দাপটে বাড়িঘর ছেড়ে এখনো আমরা এলাকাছাড়া। ভিটাবাড়িতে থেকে মা শুধু অসহায়ের মতো পাহারা দেন।’
মানবাধিকার সংস্থা রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ‘সামাজিক অবয় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় হত্যার মতো অপরাধ দিন দিন বাড়ছে।’
শার্শা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম রবিউল ইসলাম বলেন, কয়েক দিন হলো তিনি যোগদান করেছেন। তবে ইতিপূর্বে যেসব মামলা হয়েছে, তার অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। অপরাধমূলক যেকোনো ঘটনা এড়াতে মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছেন তাঁরা। একই বক্তব্য বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি রাসেল মিয়ার।