“অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নঃ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপসনদ বাস্তবায়ন”- লেখক : শারমিন রেজা |

“অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নঃ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপসনদ বাস্তবায়ন”- লেখক : শারমিন রেজা |

“অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নঃ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপসনদ বাস্তবায়ন”- লেখক : শারমিন রেজা |

 

রাজবাড়ী বার্তা ডট কম :

সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ , রাজবাড়ী জেলা শাখা।
ওগোনারী
তোমরা আজ জেগে ওঠো
সবেমিলে এক হও ।
বেরিয়ে এসো রাজপথে
সব বাঁধা,সব শৃঙ্খল ভেঙে
বেরিয়ে এসো ঐক্যের ছায়া তলে ।
প্রতিবাদ করো সব অন্যায়ের
যারা তোমায় তুচ্ছ বলে অবজ্ঞাকরে
তোমারপ্রতি লেলিহান দৃষ্টিতে তাকায়
উঠতে -বসতে তোমায় অপমানকরে
তুমি তাদের যোগ্য জবাব দাও।
যুগ যুগ ধরে নারীর প্রতি যে বৈষম্য চলে আসছে তা দূর করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘ চেষ্টা করে যাচ্ছে। নারীর অধিকার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ করে তুলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করারলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রপ্রস্তুতের প্রচেষ্টায়জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালকে“বিশ^ নারীবর্ষ” হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য আরও কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ক সনদ বাকনভেনশেন। ইংরেজতে একে বলা হয়েছে Convention on the Elimination of all Forms of Discrimination Against Women বা সংক্ষেপে CEDAW (সিডও)। বলাযায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সিডও নামের এই সনদ বাকনভেনশেন গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে নারীর জন্য সমান অধিকারের লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

 

বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ, নারী জাতির মর্যাদা বিষয়ক কমিশন এবং সাধারণ পরিষদের মধ্যে ৭৫বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা সফল পরিনতিতে এই সনদ গৃহীত হয়। সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতার ভিত্তিতে বিবাহিতা-অবিবাহিতা নির্বিশেষে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক , নাগরিক ইত্যাদি সকল বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে আইন প্রনয়ন করে বৈষম্য মূলক আচরণের অবসানের জন্য সনদে আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া কনভেনশনে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমতা স্থাপন দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য এবং প্রচলিত যেসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারা বৈষম্যকে স্থায়ী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে সেগুলো পরিবর্তনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্যে এই সুপারিশ মালায় রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নারীর সমান অধিকার, শিক্ষায় সমান সুবিধা ও পাঠ্যক্রম অনুসরনে সমান সুযোগ, নিয়োগ দান ও বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য হীনতা এবং বিবাহ ও মাতৃত্বের ক্ষেত্রে চাকুরীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান। সনদে পরিবারিক জীবনে নারীর পাশাপাশি পুরুষের সমান দায়িত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৮০ সালের ১লা মার্চ সনদে স্বাক্ষর শুরু হয় এবং এটি ১৯৮১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। ইতিমধ্যে ১৫০টির ও অধিক দেশে এই কনভেনশন অনুমোদন করে স্বাক্ষর দান করেছে। বাংলাদেশ এই দলিল অনুমোদন করে স্বাক্ষর করেছে ১৯৮৪ সালের ৬ই নভেম্বর। এই কনভেনশন বাসিডও দলিলের মূলমর্মবাণী হলো সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুগযুগ ধরে নারী যে গঠন মূলকভূমিকা পালন করে আসছে সেই ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতি এবং সার্বিক ভাবে গোটা বিশে^র শান্তি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতা স্থাপন করা ।

 

এরজন্য আইনপ্রনয়ণ, প্রচলিত আইনের সংস্কার, আইনপ্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি যা কিছু প্রয়োজন, সনদে শরীক রাষ্ট্র গুলোতার সকল ব্যবস্থা গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । এই কনভেনশন, “নারীর প্রতি বৈষম্য” বলতে বুঝায় পুরুষ নারী ভিত্তিতে যে কোন পার্থক্য বঞ্চনা অথবা বিধিনিষেধ যার মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সামাজিক, সাংস্কৃতিক নাগরিক অথবা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে মৌলিক স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়া, তা ভোগ করা অথবা বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে পুরুষ ও নারীর সমতার ভিত্তিতে নারীর দ্বারা তার ব্যবহার বা চর্চা , ক্ষতিগ্রস্থ অথবা দরকার মত প্রভাব বা উদ্দেশ্য রয়েছে। অভিন্ন পারিবারিক আইন না থাকায় সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, চারটি প্রধান ধর্মাবলম্বীর পারিবারিক আইনে পার্থক্য থাকার কারনে সমাজে অবিচার রোধ করা যাচ্ছে না এবং সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কাজেই সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীপুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা বর্তমান সময়ের দাবী। অভিন্ন পারিবারিক আইন না থাকায় সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

তাই সাংবিধানিক ধারার সঙ্গে সংগতি রেখে তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকারসহ সকল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রনয়ন জরুরী। নারীকে যদি মানুষ ভাবতেনাপারিতা হলে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোকনা কেন , ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা যাবে না। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর এই সংগঠন গণতান্ত্রিক , অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে হিমালয় সমঅর্জন থাকলেও নারীর মানবাধিকার , নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। বক্তারা অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রনয়ণের দাবী জানান এবং এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান। এতকিছুরপরও দেখা যায়, নারী ও কন্যা হওয়ার কারনে তারা নিয়তবহুমুখী সহিংসতার স্বীকার হচ্ছে। এরঅন্যতম কারণ নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তি জীবনে নারীর অধিকারহীনতা ।

 

স্বাধীনতার ৫০ বছরপরও নারীপূর্ণ নাগরিক হিসেবে তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব নারী এই অধিকারহীনতার শিকার। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে নারী পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারে সাংঘর্ষিক হচ্ছে প্রচলিত ধর্মভিত্তিক ‘পারসোনালল’। এই পরসোনাল ল ধর্মেরভিত্তিতে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার , সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে, যা নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকার লাভের পরিপন্থি। এই পারিবারিক আইন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক বিভাজন আনছে। যা শুধু নারী পুরুষ নয়, নারীতে নারীতে বিভাজন সৃষ্টি করছে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন , সম্পত্তিতে নারী –পুরুষের সম-অধিকারের প্রশ্নটি ন্যায্যতার সংঙ্গে যুক্ত। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলোকে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। নারী আন্দোলন মনে করে নারীরা মনে করে নারীর প্রতিসহিংসতা প্রতিরোধ জেন্ডার সমতা আনয়নের ক্ষেত্রে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহন বিশেষ শক্তি যোগাবে। সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির সংঙ্গে আইনের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী জড়িত। সমাজ ও জীবনের সব ক্ষেত্রেনারী –পুরুষ সমতার সংঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের সংঙ্গা নির্ধারণ , আইনের সংস্কার ,নতুন আইন প্রণয়ন সব সময় হয়ে এসেছে। আজকে বাংলাদেশের নারীর সামগ্রীক অবস্থানের সংঙ্গে সংগতি রেখেতার অগ্রগতি, বিকাশের পথে বাধা দূর ,ন্যায্য অধিকার পাওয়া ,সর্বোপরিমানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহন ও বাস্তবায়ন অঙ্গীকার আজ সময়ের দাবি। আজকের দিনে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দাবি বৈষম্যপূর্ণ আইন বাতিল করে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ গ্রহণ করে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হোক।
লেখক ঃ- শারমিন রেজা ,সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ , রাজবাড়ী জেলা শাখা।

Explore More Districts